প্রকৃত ঘটনা জানতে চায় নিহতদের পরিবার, বিচার চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে

কোথা থেকে কী হয়ে গেলো। আমার স্বামী কাজে গিয়েছিলেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। দুপুরে খাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। পরে রাস্তায় গুলি খায়। আমাকে তার কোম্পানির লোকেরা বলে— ফারুক মনে হয় গুলি খেয়েছে। হাসপাতালে ছুটে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পাই। আমি এই মৃত্যুর বিচার চাই। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার মুরাদপুরের কাছে মারা গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন, তিনিও স্বজনহারা। আমাদের ব্যথা তিনি জানেন। আমরা এই শোকের সময়ে তাকে কাছে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এ কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর একটি দোকানের কর্মচারী নিহত ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার।

সীমা রবিবার (২৮ জুলাই) গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি জানতে চান, আসলে কী ঘটেছিল।

সীমা আক্তার বলেন, আমার ১২ বছরের এক ছেলে ও ৬ বছরের মেয়েটি এতিম হয়ে গেছে। সবার বাবা থাকবে, ওদের নেই। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে নিহত ৩৪ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা রবিবার (২৮ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে দেখা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত্বনা দেন।  নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফয়সাল ইসলাম শান্তর বাবা জাকির হোসেন এসেছিলে গণভবনে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সাংবাদিকরা চাইলে অনেক কিছু উদঘাটন করতে পারে। কারা করলো সেটা আমরা জানতে চাই, বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিচার করবেন। আমার ছেলেটা চারটা টিউশনি করে সংসারের হাল ধরেছিল। প্রধানমন্ত্রী এই মন খারাপের ভেতর আমাদের ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন, সহায়তা দিয়েছেন, সেটার জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা বলেছি, দুষ্কৃতদের কোনও দল হয় না। আন্দোলনে গুলি করলো কেন? যারা করেছে তাদের বিচার করতে হবে। এই টাকা-পয়সা কে খাবে, ছেলেই তো নাই।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র নিহত ওয়াসিম আকরামের চাচা জয়নাল আবেদীন এসেছিলেন গণভবনে। তিনিও মনে করেন, সাংবাদিকরাই পারবেন প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে। তিনি বলেন, ওয়াসিমের বাবা আর এক ভাই সৌদি আরবে থাকে। তারা আসতে পারেনি। ওই দেশে মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে আছে ছেলে মৃত্যুর খবর শুনে। দেশে আছেন তিন বোন আর মা। জয়নাল আবেদীন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার ভাতিজা কীভাবে মারা গেলো— সেটা জানতে পারলে প্রাণের কষ্ট একটু কমতো। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পরিবারকে ডেকে নিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন, পাশে থাকবেন বলেছেন, তাকে ধন্যবাদ। 

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নিহত আবু সাঈদের ভাই রমজান এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা বিচার চাই। কে মেরেছে তার ভিডিও ফুটেজ আছে। আমরা দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন, আমরা কী চাই। আমরা জানিয়েছি, আমরা বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন—স্বজন হারানোর বেদনা তিনি বুঝেন। এর বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি। এর আগে আবু সাঈদের মা বলেন, যে পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে, আমি তার বিচার চাই। বিচার যেন এমন হয়, যা দেখে আর কোনও মায়ের বুক খালি করার সাহস কেউ না পায়। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন। আমার দাবি, আমার ছেলের নামে সরকার যেন একটা মসজিদ তৈরি করে দেয়।

কথা বলতে গিয়ে ডুকরে ওঠেন ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ বর্ষের ছাত্র ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া। কেবল জানেন, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে তার ছেলে মারা গেছে। গত ১৮ জুলাই বেলা পৌনে ৩টার দিকে কেউ একজন কল করে খবরটা দিয়েছিল তাকে।

শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাক্ষাতে এই হত্যা কারা করলো, তা জানতে আবেদন জানিয়েছি আমরা। আমি তো আর সন্তান ফিরে পাবো না। আমি জানতে চাই।

দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরোর চিফ ও দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট প্রেস ক্লাবের সদস্য এটিএম তুরাবের ভাই আবুল আহসান মো. আজবর তার ভাই যেখানে নিহত হয়েছেন, সে জায়গাটা ভাইয়ের নামে নামকরণ চান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি এই আবেদন জানানোর পাশাপাশি বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আজবর বলেন, কোর্ট পয়েন্টের নাম হোক তুরাবের নামে। সিলেটে এভাবে কোনও সাংবাদিক মারা যায়নি। তার শরীরে ৯৮টি স্প্লিন্টার। এই বছরই মে মাসের ১৩ তারিখে সে বিয়ে করে এবং জুন মাসে তার স্ত্রী তানিয়া ইসলাম লন্ডনে চলে যায়। তুরাবেরও লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল।

উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে রবিবার দুপুরে গণভবনে সাক্ষাৎ এবং আর্থিক সহায়তা তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার চেষ্টা থাকবে—যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, খুঁজে খুঁজে বের করে তারা অবশ্যই যেন শাস্তি পায়, সেটাই আমার প্রচেষ্টা থাকবে, আমি সেটাই করবো।’