আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া পর রাজধানীতে ডিএমপির অন্যান্য থানার মতো খিলক্ষেত থানায়ও হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিভিন্ন সরঞ্জাম, যানবাহন ও অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাটসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো ভবন। অগ্নিসংযোগে থানার একাধিক কক্ষ ও আসবাসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভবন সংস্কার করে থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তবু এখনও পরিবহন, লোকবল ও সরঞ্জামসহ নানা সংকটে রয়ে গেছে।
অন্যদিকে সারা দেশ ও রাজধানীতে থানা পুলিশের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলেও এখনও হামলা-মামলার ভয় রয়ে গেছে পুলিশের সদস্যদের মাঝে। তারা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। অপরাধ দমনে পুলিশকে কঠোর হতে হয়। মব, চুরি-ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ কিংবা অপরাধীদের ধরতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে যদি পুলিশ সদস্যদের হামলার শিকার হতে হয়, তাহলে আইন প্রয়োগ বা প্রবিধান মানা কঠিন হবে। কেননা পুলিশ বাহিনী চলে চেইন অব কমান্ডে।
তারা আরও বলেন, ঊর্ধ্বতনরা যে আদেশ বা কমান্ড করবেন, সেভাবেই পুলিশের নিম্নস্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যদের কাজ করতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা না দিলে সেটা সম্ভব হবে না।
সরকার পতনের তিন দিন পর খিলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে অস্থায়ীভাবে থানার কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। পরে থানা ভবনের সংস্কার শেষে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে থানার নিজস্ব ভবনে শুরু হয় পুলিশিং কার্যক্রম। বিগত সময়ে পুলিশ সদস্যদের দলীয় বাহিনীতে ব্যবহার করার কারণে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে ওসি-পরিদর্শকদের বদলি করা হয়েছে। যুক্ত করা হয় নতুন সদস্যদের।
খিলক্ষেত থানার পুলিশ সদস্যরা জানান, অভিযুক্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে স্বচ্ছ ইমেজের পুলিশ সদস্যদের দেওয়া হয়েছে এ থানায়। যাতে পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সুসম্পর্ক স্থাপন হয় এবং পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ২৩ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ২৪ জন সহকারী উপপরিদর্শকসহ (এএসআই) ৯৮ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন এই থানায়। তবে এখনও রয়ে গেছে যানবাহনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম-সংকট। থানা পুলিশ জানায়, গত ৫ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাঁদাবাজি, মারামারি, দখলদারত্ব ও মাদক-সংশ্লিষ্ট ২৩টি মামলা করা হয়েছে। এ সময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়া অভিযোগে ৪৭৫টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে সাধারণ মানুষ।
আলাপকালে থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেন, বর্তমানে থানার ওসি থেকে শুরু করে বেশির ভাগ পদে নতুন সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছে। আগের সদস্যদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। নতুন সদস্যরা বিগত সময়ের ভয়ংকর পরিস্থিতি মাথায় রেখে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছেন। যাতে আর কোনও ৫ আগস্ট সৃষ্টি না হয়। তবে মাঠ পর্যায় পুলিশ সদস্যরা এখনও নানা ধরনের সংশয়ের মধ্যে আছেন। বিশেষ করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজেরাই খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্কে আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশ চেইন অব কমান্ডে চলে। ঊর্ধ্বতনরা যে কমান্ড করবেন, মাঠপর্যায়ের সদস্যরা সেটাই বাস্তবায়ন করবেন বা সেভাবে কাজ করবেন। বিগত সময়েও তা-ই করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বলয়ে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিম্নস্তরের সদস্যদের দিয়ে নানা অপকর্ম করিয়েছেন। মামলা হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, তাদের বিচার হবে। মাঠপর্যায়ের সদস্যরা কেন হামলা-মামলার শিকার হবেন?
পুলিশের এক সদস্য বলেন, থানার বিট বা এলাকাভিত্তিক টহল পুলিশিং কার্যক্রম স্থবির থাকার সুযোগে ছিঁচকে অপরাধ বেড়েছে। পুলিশের আইন বা প্রবিধান অনুযায়ী পাঁচজন বা তার অধিক মানুষের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলিশকে অ্যাকশনে যেতে হবে। সেই মব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যদি কোনও সদস্য হামলা শিকার হন কিংবা তার বিরুদ্ধে মামলা করে, তাহলে সে সদস্য কী করবেন? প্রত্যেক সদস্যদের জীবনের ভয় আছে। কারণ তারও পরিবার আছে।
আরেকজন বলেন, কিছুদিন আগে রাজধানীতে একটি মব বা বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের সদস্যদের অ্যাকশনে যাওয়ার আদেশ করেন। অথচ সদস্যরা ঊর্ধ্বতনদের কমান্ড মানেননি। আর সে জন্য কয়েকজন সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু ঘটনায় পুলিশ কঠোর হয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করায় সেসব সদস্যকে অপরাধী বানিয়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সুনির্দিষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।
খিলক্ষেত থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানায় যেকোনও সেবাগ্রহীতা আসার সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী আমরা সেবা দেওয়া চেষ্টা করছি। ওসি স্যারের নির্দেশে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছি। প্রতিটি অভিযোগ আমলে নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি ভুক্তভোগীদের ওসি স্যারের কাছেও পাঠানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম বলেন, যানবাহন সংকট থানায় এলাকাভিত্তিক টহল কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি ঠিকই। তবে যেকোনও সমস্যার সৃষ্টি হলে বা ভুক্তভোগীদের যেকোনও অভিযোগ আমলে নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। যে কেউ অভিযোগ নিয়ে থানা এলে তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনও পুলিশ সদস্যরা বদলির মধ্যে আছে। এটা স্বাভাবিক হয়ে এলে এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু—এটা কথায় নয়, আমরা সত্যিকারের জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের পুলিশ সদস্যদেরও মনবল শক্ত ও সেবার মান বৃদ্ধিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
কী ঘটেছিল সেদিন
গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সরকার পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়া পর লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের ওপর ও বিভিন্ন থানায় হামলা চালায়। থানার স্থাপনা অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটপাট করা হয়।
খিলখেত থানায় কর্মরত ও ৫ আগস্টে থানায় হামলা ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী উপপরিদর্শক (এসআই) রায়হান বাদশা বলেন, ৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে সেনাবাহিনীর কারফিউ চলছিল। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১দিকে সেনাবাহিনীর কারফিউ ভেঙে উত্তরা থেকে হাজার হাজার মানুষ শাহবাগের দিকে যাচ্ছিল। আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো সবাই যেন থানার সামনে থেকে থানা রক্ষা করি। পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সরকার পতনের কথা শুনে রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ নেমে আসেন। এর মধ্যে কিছু মানুষ আমাদের লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে ওসি স্যারসহ আমারা দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য থানার ভেতরে গিয়ে গেট বন্ধ করে দিই। কিছুক্ষণ পর গেট ভেঙে বিক্ষুব্ধ জনতা ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে আমার প্রাণভয়ে থানার পেছন দিয়ে পানির পাইপ বেয়ে পালিয়ে যাই। আমরা থানা ভবন ত্যাগ করতে সামান্য দেরি করলেই হয়তো পুড়ে মারা যেতাম। তবু সেদিন তাদের হামলায় ওসিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছিলেন।
তিনি জানান, বিক্ষোভকারীরা সেদিন থানায় ঢুকে ওসির গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে নামাজের কক্ষ, ওসির রুম, সেরেস্তা (মামলা নথিপত্র) রুম ও দোতলা পুলিশ সদস্যদের থাকার একটি রুম পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়া থানা ভবনের প্রতিটি জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। থানার ভেতর থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়।
লুটপাট ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
থানা সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট বিকালে খিলক্ষেত থানায় সেরেস্তা কক্ষ (মামলা, জিডিসহ থানার নথিপত্রে কক্ষ), ওসির কক্ষ, পুলিশের থাকার জায়গা ও মালগার কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং ব্যাপক লুটপাট করা হয়। এ সময় অস্ত্রাগার থেকে রিভলভার ও চায়নিজ পিস্তলসহ ২৩টি অস্ত্র লুট করা হয়েছে। সাউন্ড গ্রেনেড, টিআর শেল ও বিভিন্ন অস্ত্রের প্রায় দুই হাজার রাউন্ড গুলি লুট হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় থানায় জব্দকৃত মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক ও সিএনজিসহ অন্তত ৫৫টি যানবাহন এবং থানার ব্যবহৃত ১২টি গাড়ি আগুন ধরিয়ে দেওয়া এবং লুট করা হয়। পুলিশের ব্যবহৃত হ্যান্ডকাফ, বেস্ট, ওয়াকিটকি এবং কম্পিউটার, প্রিন্টার, সিসি ক্যামেরা, ডিবিআর, এসি, দরজা-জানালার ক্ষতি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা সমমূল্যের।
উল্লেখ্য, গত জুলাইয়ে ঢাকাসহ দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলন চলে, যা পরে সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। যোগ দেয় জনতা। এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর বিভিন্ন জেলায় অন্তত পাঁচ শতাধিক থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাজধানীর প্রায় ২২টি থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।