রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাংলাদেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বাস্তব পরিবর্তন ও সংস্কার সম্ভব হবে। তাদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পুলিশ সংস্কার কার্যকর হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) আয়োজনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। সংগঠনটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংলাপের সূচনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। সংস্কারের কথা আমরা অনেক শুনি, কিন্তু বাস্তবতার আড়ালে সংস্কার এখন এক ধরনের ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পারছে না। জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে সংস্কার করতে হবে, শুধু পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়।’
কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব হবে না বলেও উল্লেখ করেন আ ন ম মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
মুনীরুজ্জামান বলেন, পুলিশের মনোবল ও মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের প্রশিক্ষণ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও উন্নত করা প্রয়োজন। এছাড়া জনগণেরও পুলিশের কার্যক্রমে সহায়তা করতে হবে, যাতে জনগণ পুলিশকে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে পায়।
বিএনপির উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকারের কিছু মন্তব্যের ফলে মনে হয়েছে যে, ক্ষমতায় না থাকলে দেশে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটবে এবং পুলিশের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘এটা পরিহার করতে হবে এবং পুলিশের কাজ সেবা প্রদান করা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, এটা বুঝতে পারা যে পুলিশ সেবামূলক কাজ করতে আসে।’
সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক পুলিশের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের আদেশের বিরুদ্ধে বলার সাহস যদি না থাকে, তবে পুলিশ বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, আগে যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার প্রয়োগ হয়নি। তাই এবার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে পুলিশি কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে এবং সাংস্কৃতিক আত্মস্থকরণ প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, পুলিশকে ‘হেনস্তাকারী’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এবং ট্রাইবালিজম বা গোত্রতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশি পদন্নতির জন্য অধিকাংশ সময় উপরের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়, যা সংস্কারের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. জারিফ রহমান বলেন, ‘পুলিশ ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করলেও দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর বিকেন্দ্রীকরণেও জোর দেন।
আলোচনায় শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রেজওয়ানা রশীদ বলেন, ‘পুনর্গঠন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। পুলিশে শিক্ষা সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং কমিউনিটি পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হবে।’ তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে পুলিশের কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
পুলিশের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে চালানোর জন্য বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলো’র যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা না হয়।
গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এখন খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে উল্লেখ করে সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং পুলিশকে ব্যবহারের জন্য বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমি ওয়াদুদ, দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশ এ কে আজাদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক সাফকাত মুনির, আইনজীবী রাশনা ইমাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও শিক্ষার্থী কাজী রাকিব হোসেন প্রমুখ।