বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক: আইন সংশোধনী নিয়ে শঙ্কা আইনজীবীদের

রহিম তার গ্রামের এক তরুণীকে বাড়ি-গাড়ি করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বিয়ের প্রলোভনে দীর্ঘ ছয় মাস ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে সে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে মামলা করতে চায় পরিবার। ক্ষিপ্ত রহিম ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাবাকে মারাত্মক আহত করে। স্থানীয়রা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। রহিম ও তার পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ থানায় মামলা করতে সাহস পাননি।

আইনে ‘ধর্ষণ’ উল্লেখ থাকার পরেও যখন সাহসে কুলায় না, তখন ‘বিয়ের আশ্বাস’ শব্দ ব‍্যবহারে কতটা ন‍্যয়বিচার পাওয়া যাবে— তা নিয়ে শঙ্কিত অধিকারকর্মীরা। আবার অন‍্য শঙ্কাও আছে বলছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা তা রক্ষা করা একটি নৈতিক এবং সামাজিক বিষয়। কিন্তু সে বিষয়টিকে আইনগতভাবে ব্যাখ্যা করে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে শুধু প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার কারণে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়।

উল্লেখ‍্য, সম্পর্কের টানাপড়েন, ব্যক্তিগত মতপার্থক্য বা পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছুটা পরিবর্তন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগে মামলায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। পরিবর্তিত আইনে বলাৎকার ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের বিষয়ে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আলাদা একটা সেকশনে বিচার হবে। এটা আলাদা অপরাধ না, একই অপরাধ। একই আইনের আওতায় পৃথকভাবে এটা হলো।

সংশোধিত আইনটির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই সংশোধনীর ফলে ছেলেরা অপরাধ করলে সহজে ধরা পরবে। এতে মামলার সংখ্যাও বাড়বে। তাই যে কোনও সম্পর্ক করার আগে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত হবে। সম্পর্কের নামে অসামাজিক কাজ বন্ধ হবে। তবে আইনটির কারণে মামলা বেড়ে যাবে। এর মানে ক্ষেত্র বিশেষে কথায় কথায় মিথ্যা মামলা হবে।’

এই আইন পাস হলে সমাজে ব্লাকমেইলিং বেড়ে যাবে, সমাজে হানাহানি বেড়ে যাবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ইশরাত হাসান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক একের অধিক বার বা একাধিক জনের সঙ্গে হতে পারে। ফলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যখন ইচ্ছা তখন মামলা করতে পারবেন। পুরুষ শোষণের হাতিয়ার হবে এই আইন।’

সংশোধিত আইনের প্রায়োগিক দিকগুলোর ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘এই আইনের ফলে অফিসের নারী সহকর্মী তার বসের বিরুদ্ধে, নারী মক্কেল তার আইনজীবীর বিরুদ্ধে, ছাত্রী তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে– এভাবে যেকোনও নারী এই আইনকে ব্যবহার করে আদালতে বা থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করতে পারবে। যে কারও প্রাক্তন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে আসবে অনায়াসে। এর খারাপ প্রভাবে পুরুষরা ব্ল‍্যাকমেইলের শিকার হবে, যা তাদের আরও প্রতিশোধপরায়ণ করবে এবং নারী বিদ্বেষী করবে। এটি একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার অন্তরায় হয়ে উঠবে।’

সামাজিক বিশ্লেষণের জায়গায় অধিকারকর্মী জিনাত আরা হক বলেন, ‘বিয়ে মানে দুপক্ষের সম্মতি। সেখানে কনসেন্টের বা সম্মতির ব্যাপার থাকে। বিয়ের প্রলোভন বা আশ্বাসে শারীরিক সম্পর্ক বিষয়টা উল্লেখ রাখাটাকে আমি প্রগ্রেসিভ চিন্তার ফসল বলতে পারছি না। বিষয়টা এ রকম– নারীকে আশ্বাস বা প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা যায়। নারীকে এমন প্যাসিভ জায়গায় আমরা আইনি পরিসরে দেখতে চাই না।’