সম্প্রতি প্রকাশিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল মহল নারীবিরোধী এবং ঘৃণা-প্রচারমূলক প্রচারণা শুরু করেছে। যা সংবিধানে স্বীকৃত নারী-পুরুষ সমতার অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে। আর এই পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের ভবিষ্যৎ কী, তা জানতে চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছে।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) বিকাল ৩টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন অডিটোরিয়ামে ‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা একজোট’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় এসব বিষয় উত্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারী ও শিশুর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা রোধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে ১৬টি সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
গণসাক্ষরতা অভিযান এবং আরও ৮টি সহযোগী সংগঠন- ব্র্যাক, এডুকো, এমজেএফ, নেটজ বাংলাদেশ, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এবং সাইটসেভার্স বাংলাদেশ যৌথভাবে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সংহতি গড়ে তোলা এবং নীতিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
মতবিনিময় সভায় গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য রাখেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। নারী অধিকার আদায় সহজ কোনও বিষয় নয়, এ দাবি বহুদিন ধরে চলছে। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হবো।
আরেক গেস্ট অব অনার অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই সংগ্রাম চলছে। নারী সংস্কার কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যারা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতা করছে তা চিহ্নিত হয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনেক দাবি বাস্তবায়ন করতে পারবো। আরও কিছু সুপারিশ নারী ও শিশু নির্যাতনের দাবির সঙ্গে যোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
এই উপদেষ্টা আরও বলেন, সাইবার বুলিং নিয়ে আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। আছিয়ার ঘটনা আপনারা দেখেছেন। যারা এই ধরনের নির্যাতনের মতো ঘটনায় যুক্ত তারা পুরুষও না, কাপুরুষও না, তারা জন্তু। এদের জন্য আমাদের শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে। এই অপরাধীদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক তাপতুন নাসরীন বলেন, ঘোষণাপত্রের ১৬টি বিষয়েই বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করছে। তিনি উল্লেখ করেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রাপ্ত তথ্য কর্মক্ষেত্রে চর্চা করতে সবাইকে অনুরোধ জানাবেন। এসব অন্যায়ের মূল কারণগুলো সংশ্লিষ্টদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সভায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভবিষ্যৎ কী তা জানানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অধিকার সমান দাবি করে বক্তব্য রাখেন।
আইনজীবী, বিশিষ্ট আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আইনকর্মী ব্যারিস্টার ড. শাহদীন মালিক বলেন, শাস্তি বেশি হলে অপরাধ প্রবণতা কমবে। নারীর প্রতি সহিসংতা কমাতে বিচার ব্যবস্থা আরও কঠোর করতে হবে।
নিজেরা করি সংগঠনের কো-অর্ডিনেটর খুশি কবীর বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, নারীর প্রতি সহিংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ঘোষণাপত্রের দাবিগুলোর সঙ্গে সহমত, তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের বিষয়টি সংযোগ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য এবং কর্মসূচির উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক তপন কুমার দাশ। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক ‘ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের ইয়ং প্রফেশনালস জেনেট পাপড়ি রায় এবং ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গারের আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ শিহাব।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, গণসাক্ষরতা অভিযান কাউন্সিল প্রতিনিধি, এডুকেশন ওয়াচের প্রতিনিধি, শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক সংগঠন, ঢাকায় দূতাবাসের প্রতিনিধি, ব্র্যাক, গণসাক্ষরতা অভিযান, এডুকো, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নেটজ বাংলাদেশ, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ, সাইটসেভার্স বাংলাদেশের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম কর্মীসহ প্রায় দুই শতাধিক মানুষ এতে অংশ নেন।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা একজোট ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় কমপক্ষে একবার নিজ গৃহেই কোনও না কোনও ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণসহ আরও কিছু সূচকে অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য সূচকে ৪০ ধাপ পিছিয়ে ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে ৯৯তম স্থানে রয়েছে (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২৪)।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল মহল নারীবিরোধী এবং ঘৃণা-প্রচারমূলক প্রচারণা শুরু করেছে, যা সংবিধানে স্বীকৃত নারী-পুরুষ সমতার অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও পাবলিক ফোরামকে ক্রমবর্ধমানভাবে নারীদের কণ্ঠরোধ, অবমাননা, অপদস্থ করা এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের নারী যেমন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী, চিকিৎসক, উন্নয়নকর্মী, শ্রমজীবী নারী, এমনকি গৃহকর্মীরাও আজ হেনস্তার শিকার হচ্ছেন এবং চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনও সুস্পষ্ট বক্তব্যও আমরা পাইনি। যার ফলে নারীর মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে এবং গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়
যেসব নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নারী ও শিশুদের উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করা।
নারীর মর্যাদা হানিকর সব প্রকার প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে অনেক সময় বিভিন্ন কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানের আগে বা পরে নারীবিদ্বেষী, নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এমন বক্তব্য প্রদানকারীদের আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের ব্যক্তিবর্গ ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রচারাভিযান ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন কোনও ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
নারীর অধিকার আদায়ের যেকোনও আন্দোলনকে দলীয় রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার কিংবা হয়রানি করার অপচেষ্টাকে রুখে দিতে হবে। নারীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার প্রবণতা কঠোরভাবে দমন করতে হবে।