পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি: আসলে কী ঘটছে

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র থাকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে, পুলিশের হাতে যেন প্রাণনাশী অস্ত্র না থাকে। একদিকে যেমন আত্মরক্ষার যৌক্তিক প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের অতিরিক্ত গুলি চালানোর অভিযোগও উঠে আসে। এসব মিলিয়ে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়।

এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনেও একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার সুপারিশ করেন। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সরকার জানিয়েছে, পুলিশের হাতে চায়নিজ রাইফেল, সাবমেশিনগান (এসএমজি), ৯ এমএম পিস্তলের মতো মারাত্মক অস্ত্র আর থাকবে না।

এই ঘোষণার পরই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়—পুলিশ যদি এই ধরনের অস্ত্র থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তারা কীভাবে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করবে বা বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করবে? কারণ, অভ্যুত্থানের সময় অনেক মারাত্মক অস্ত্র লুট হয়ে যায়, যার বড় একটি অংশ এখনও সন্ত্রাসীদের হাতেই রয়েছে এবং তা এখনও উদ্ধার হয়নি।

পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, পুলিশকে দুর্বল করার এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।

তবে পুলিশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহল বলছে, টহল বা চরমপন্থি ও বিদ্রোহপ্রবণ এলাকায় অপারেশন চলাকালে পুলিশ প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র বহন করবে। তবে এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র থাকবে কেবল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কাছে।

এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের সংস্কার দরকার। তবে বাস্তবতা বিবর্জিত সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ মানুষ নয়, বরং অপরাধীরাই সুযোগ নেবে। অস্ত্র আইন প্রয়োগের একটি অপরিহার্য উপকরণ, যা ছাড়া পুলিশের পক্ষে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হবে।

মাঠ পর্যায়ে কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অস্ত্র ব্যবহারের সক্ষমতা কমিয়ে দিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের সময় মোট ৫ হাজার ৭৫৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়, যার মধ্যে ৪ হাজার ৩৮৪টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনও ১ হাজার ৩৬৯টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি, যেগুলোর বড় একটি অংশ সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বলেন, ‘বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, বাস্তবে তা নয়। পুলিশের টহল, চরমপন্থি বা বিদ্রোহপ্রবণ এলাকায় অপরাধ দমনে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার জরুরি, তবে বাস্তবতা বিবর্জিত ও কাল্পনিক সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণ নয়, বরং অপরাধীরাই লাভবান হবে। মাদক উদ্ধার, সন্ত্রাস দমন, চরমপন্থি দমনসহ নানামুখী কার্যক্রমে পুলিশকে অস্ত্র ছাড়া দায়িত্ব পালন করতে হলে তার ফল হবে বিপরীত।’

তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র অপব্যবহার হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু অস্ত্রই যদি তুলে নেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ কার্যকর থাকবে না। উন্নত দেশগুলোতেও পুলিশের কাছে অস্ত্র থাকে—মূল বিষয় হলো সেই অস্ত্রের ব্যবহার যেন স্বচ্ছ, যুক্তিসঙ্গত ও জবাবদিহিমূলক হয়।’

এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর নতুন প্রেক্ষাপটে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি কেবল জনশৃঙ্খলা রক্ষায়। বিশেষ করে মিছিল-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে। সেই পর্যালোচনার লক্ষ্য হলো, মিছিল-সমাবেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা, তা খতিয়ে দেখা। পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে এবং মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।’