তামাক চাষে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, বিপন্ন টেকসই কৃষি

বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে আবাদযোগ্য জমি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সম্প্রতি দেশে তামাক চাষ ক্রমেই বাড়ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাপী যেখানে তামাক চাষ ও ব্যবহার কমছে, সেখানে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল কিছু দেশে এর চাষ বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বসবাসের উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে তামাকের মতো আগ্রাসী ও ক্ষতিকর ফসলের সম্প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে সেখানে অন্য ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ধানসহ অনেক ফসল সময়মতো পাকলেও গাছ শুকিয়ে যায়। এ ছাড়া স্থানীয় জাতের ফসল আবাদের অভাবে সেগুলোর বীজ সংরক্ষণের সুযোগও হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা বেশি লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষক এখন তামাক চাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন বলে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

বিশ্বজুড়ে চাষযোগ্য জমির মাত্র ০ দশমিক ৩ শতাংশ তামাক চাষে ব্যবহার হলেও এর পরিবেশগত ক্ষতি অনেক বেশি। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হলেও ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯ মিলিয়নে। এর প্রধান কারণ—তামাক চাষে মাটির মারাত্মক ক্ষতি হয়, এতে প্রচুর কীটনাশক ও পানি ব্যবহৃত হয় এবং তামাক শুকানোর জন্য বনজ সম্পদ নিঃশেষ হয়।

বাংলাদেশে একশ্রেণির ব্যক্তি ও কোম্পানি নানা সুবিধা ও প্রলোভন দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে। তারা অগ্রিম টাকা, বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে কৃষকদের এ চাষে আকৃষ্ট করছে। এতে কৃষকেরা স্বল্প খরচে তুলনামূলক বেশি লাভের আশায় তামাক চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন, যদিও এটি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

তামাক চাষের ফলে মাটি ক্ষয়, পানি ও পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। যেমন—কুষ্টিয়া এক সময় খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হলেও বর্তমানে সেখানে শাকসবজি, ডাল, পাট ইত্যাদির জায়গায় তামাকের বিস্তার ঘটছে। একই পরিস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামেও দেখা যাচ্ছে।

তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ভূ-উপরি ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও এসব রাসায়নিক জমা হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি। এ ছাড়া, মাটির গঠন বজায় রাখার জন্য যে অণুজীব প্রয়োজন, অতিরিক্ত বিষাক্ত উপাদান ব্যবহারে তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও জাপান টোব্যাকো কোম্পানিসহ কয়েকটি বিদেশি ও দেশীয় কোম্পানি তাদের প্রতিনিধি ও স্থানীয় মহাজনের মাধ্যমে চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। চাষিরা তাদের তামাক গুদামে জমা দেন এবং কোম্পানির প্রতিনিধিরা জাত অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করেন। ‘জাতি তালিম’ তামাক প্রতিমণ ২ হাজার ৪০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা এবং ‘বিলাতি মতিহারি’ তামাক ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রধানত তিন জাতের তামাক—জাতি, মতিহারি ও ভার্জিনিয়া চাষ করা হয়। জাতি ও মতিহারি তামাক মূলত রংপুর ও বান্দরবানে, আর ভার্জিনিয়া জাতের তামাক চাষ হয় কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর ও মানিকগঞ্জে। বার্লি জাতের তামাক সীমিতভাবে চাষ হয়।

তামাক কোম্পানিগুলো মাটির উর্বরতা হারানো এবং জ্বালানি কাঠের সংকটের কারণে নতুন নতুন এলাকায় চাষ সম্প্রসারণ করছে। যেমন—সাম্প্রতিক সময়ে যশোর, ঝিনাইদহ, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও টাঙ্গাইলে তামাক চাষ বাড়ছে।

তামাক চাষ কৃষি মৌসুমের প্রায় পুরোটা সময় দখল করে ফেলে। খরিফ-২ মৌসুমের শেষাংশ, রবি মৌসুম এবং খরিফ-১ মৌসুমের শুরুতে একটিমাত্র তামাক ফসল চাষের জন্য তিনটি মৌসুমের জমি ব্যবহার হয়, যার ফলে অন্যান্য খাদ্য ফসল আবাদ করা সম্ভব হয় না।

উবিনীগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষকরা প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ৫৭৫ কেজি ইউরিয়া ও ৪৬৬ কেজি টিএসপি ব্যবহার করেন এবং একটি মৌসুমে গড়ে ১৬ বার কীটনাশক স্প্রে করেন। তামাক ক্ষেতে ৪৭ ধরনের কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা জমিকে প্রায় মৃত করে তোলে।

চট্টগ্রামের এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, টোব্যাকো কোম্পানিগুলো নানা সুবিধা দিয়ে চাষিদের প্রলুব্ধ করছে। এতে মাটি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাদের নিরুৎসাহিত করতে নিয়মিত সভা-সেমিনার হচ্ছে।

কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম. এ. সোবাহান বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটি অমূল্য সম্পদ। গত ৩-৪ দশকে অতিরিক্ত চাষাবাদ ও রাসায়নিক ব্যবহারে মাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ওপর তামাক চাষ যেন বিষের ফোঁড়া।’ তিনি আরও জানান, তামাক একটি বহিরাগত আগ্রাসী প্রজাতি। ৬০-এর দশকে প্রথম তিস্তা অববাহিকায়, পরে কুষ্টিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এর চাষ শুরু হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০০১ সালে দেশে ৭৩ হাজার ৮৭০ একর জমিতে তামাক চাষ হতো। ২০১১-১২ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার একরে।

প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএস জুবায়ের বলেন, ‘তামাক চাষ বন্ধে প্রয়োজন হলে কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত। কারণ অতিরিক্ত রাসায়নিক ও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারে মাটির অণুজীব মারা যাচ্ছে এবং মাটি গঠনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।’

তামাক চাষ কেবল জমির ঊর্বরতা ধ্বংস করছে না, বরং বাংলাদেশকে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জরুরি।