গোপনে স্কুলের গাছ বিক্রি, প্রায় কোটি টাকা তছরুপ

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় গোপনে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলাধীন বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি টাকার গাছ অবৈধভাবে বিক্রি করে বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বিনা রশিদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, গোপনে বিদ্যালয়ের জমি হস্তান্তর করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. শফি উদ্দিন। কিন্তু আইনগত জটিলতায় তা পারেননি।

জানা গেছে, বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফি উদ্দিন বিদ্যালয়টির আর্থিক, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি করেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেও তার দুর্নীতি থামানো যায়নি এবং তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সভাপতিতে কৌশলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়

বিভিন্ন অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সভাপতি এ ই আব্দুল মুনিম প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতিতে প্রশ্রয় না দেওয়ায় ষড়যন্ত্র করে তাকে সরিয়ে দেন বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. শফি উদ্দিন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার পরও অনুমোদনবিহীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও খণ্ডকালীন শিক্ষকদের মাধ্যমে সাজানো নির্বাচনে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নির্বাচন করা হয়। অবৈধভাবে প্রাথমিক স্তরের জন্য শিক্ষক প্রতিনিধি মনোনয়ন দিয়ে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে এ ই আব্দুল মুনিমকে সভাপতি পদ থেকে বিদায় করে আলহাজ আব্দুল বাতেন মিয়াকে সভাপতি করা হয়।

গোপনে গাছ কেটে অর্থ আত্মসাৎ

সাজানো নির্বাচনের পর ম্যানিজিং কমিটির মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকার গাছ বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে কয়েক লাখ টাকা বিদ্যালয় ফান্ডে জমা দিলেও বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, এ পর্যন্ত ৭০-৮০টি গাছ বিক্রি করা হয়েছে। বন বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই কেটে ফেলা হয়েছে পুরোনো গাছ।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কারফিউ চলাকালে একসঙ্গে গাছ বিক্রি করা হয়। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে গাছ কাটার কারণে কোনও প্রচার বিজ্ঞপ্তি ছিল না। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যার কারণে গাছ দুর্নীতির বিষয় এলাকাবাসীর সামনে চলে আসে। এ সময় প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয় এবং তার বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ হয়ে যায়। পরে এলাকাবাসীর চাপে ১১টি গাছ বিক্রির টাকা স্কুলের ফান্ডে জমা করা হয়।

রেজিস্ট্রেশন ফরমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়

২০২৩ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারি রেজিস্ট্রেশনের টাকা আদায় করা হয় বিনা রশিদে। ষষ্ঠ শ্রেণি হতে সরকারি ফি ৫৮ টাকার স্থলে ৫০০ টাকা, অষ্টম শ্রেণি ৭৪ টাকার স্থলে ৬০০ এবং নবম শ্রেণির ১৭১ টাকা  রেজিস্ট্রেশনের স্থলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ৬০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। অতিরিক্ত ফি আদায় করা হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও রশিদ দেওয়া হয়নি। ২০২৩ সালে বছর ষান্মাষিক ৩০০ এবং বার্ষিক ৪০০ টাকা মূল্যায়ন ফি বিনা রশিদে আদায় করা হয়। জেএসসি ও এসএসসি উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে টেস্টিমোনিয়াল বাবদ ৫০০ টাকা ও বোর্ড সনদ বিতরণ বাবদ ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা বিনা রশিদে আদায় করা হয়। একই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং ফি এবং জরিমানা বাবদ অগ্রিম হিসেবে ৬০০০ টাকা একত্রে আদায় করে।

জমি হস্তান্তরের চেষ্টা

ম্যানেজিং কমিটিও দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই। অর্থের বিনিময়ে বিদ্যালয়ের জায়গার মাঝখান দিয়ে পারিবারিক রাস্তা দেয়। বিদ্যালয়ের জায়গা স্থানীয় মো. তাহেরুল ইসলাম টুটুলের জায়গার এওয়াজ বদলের সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। বিদ্যালয়ের জায়গার বাজার মূল্য অনেক বেশি। যে কারণে কমিটি লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এওয়াজ বদল করতে সম্মত হয়। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে এওয়াজ বদল করতে পারেনি। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের জায়গার মাঝখান দিয়ে রাস্তা দিয়ে বিষয়টির সমাধান করা হয়।

অন্যান্য দুর্নীতি

‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ খাতে কোনও আয় নেই। অথচ এই খাতে বিদ্যালয় তহবিলে লাখ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের সেমি পাকা ভবন বিক্রয়ে সর্বোচ্চ দরদাতার মূল্য ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, কিন্তু বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি তাদের পছন্দের লোকদের কাছে ২ লাখ ৩০ ত্রিশ হাজার টাকায় হস্তান্তর করে দেয়। এতে বিদ্যালয়ের ক্ষতি হয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মরহুম এ ই আব্দুল মুনিম ও তার আত্মীয়দের বিদ্যালয়ের অনুকূলে দানকৃত সম্পত্তির হিসাব এলাকাবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফি উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বিষয়টি এড়িয়ে যান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এগুলো ভুয়া অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় ওনারা আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দিয়েছে। তদন্ত করে দেখুক।’