বেসরকারি গবেষণা ও অধিকারভিত্তিক অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান ‘ভয়েস’ দীর্ঘদিনের কাজের ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল ও জনপরিসরের প্রেক্ষাপটের ওপর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশে ডিজিটাল ও নাগরিক পরিসরে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে, গণমাধ্যম পরিস্থিতি, মতপ্রকাশের ওপর নিষেধ এবং সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা এতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
শনিবার (২৮ জুন) বিকালে রাজধানীর একটি হোটেলে অর্ধবার্ষিকী এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন তুলে ধরে ভয়েসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নাগরিক পরিসর বা সিভিক স্পেস হলো এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের মতপ্রকাশ, সংগঠন করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অধিকার চর্চার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পরিসর অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলে লক্ষ্য করা যায়। ডিজিটাল পরিসরেও একই চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে। বিশেষ করে নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যের ব্যক্তিরা অনলাইনে ঘৃণাসূচক বক্তব্য, বিদ্বেষ, সহিংসতা ও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন, যা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।
প্রতিবেদনের তথ্যে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। অনেকেই আশা করেছিলেন— আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নাগরিক ও ডিজিটাল পরিসর মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন, এখানে নাগরিক অধিকার আরও ঝুঁকিতে পড়েছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
ভয়েস জানায়, এসব ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে মব ভায়োলেন্স বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার ঘটনা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, মাজার ভাঙচুর, নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া, নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করা ইত্যাদি ঘটনা ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রবণতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা, এমনকি হত্যা মামলার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বেশিরভাগ মামলায় ২০০ থেকে ৩০০ জন বা তারও বেশি অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম অর্ন্তভুক্ত থাকায় এসব মামলা ন্যায়বিচারের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই প্রতীয়মান হয়। এই প্রেক্ষাপটে ভয়েস গত অক্টোবর থেকে ছয় মাসে ৮০টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে ২৫টি ঘটনা বিস্তারিতভাবে কেস স্টোরি আকারে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
মনিটরিং রিপোর্টে মৌলিক স্বাধীনতা, প্রেস, বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক প্রকাশনার পাশাপাশি অনলাইন এবং অফলাইন— উভয় ক্ষেত্রেই নারীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রচলিত প্রবণতা এবং হুমকির প্রচলিত প্রবণতাগুলো স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এই ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং অনিয়ন্ত্রিত দায়মুক্তির তীব্র দুর্বলতাকেও তুলে ধরে। সব মিলিয়ে এগুলো বাংলাদেশের ডিজিটাল এবং নাগরিক পরিসর আসলেই সংকুচিত হয়ে আসছে— এমন ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, উন্মত্ত জনতার হামলা এবং অন্যান্য ধরনের দমন-পীড়ন নাগরিক পরিসর ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য গভীর সংকটের সংকেত দিচ্ছে। সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং মুক্তমনারা ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষমতার কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এবং তারপরে জবাবদিহি করার জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন, তাই প্রায়শই তারা প্রাণঘাতী শক্তি এবং প্রতিশোধের ভয়ে লাঞ্ছিত বা আরও বিষয় হচ্ছে— চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। সুরক্ষিত হওয়ার পরিবর্তে তারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অপরাধমূলক স্বার্থের ‘ক্রসফায়ারে’ ধরা পড়ে, স্ব-সেন্সরশিপে বাধ্য হয় বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার শিকার হয়। একইভাবে অধিকার কর্মী, লেখক, শিক্ষাবিদ, বিশেষ করে যারা অনলাইনে কথা বলছেন— তাদের মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে অপরাধী করা হচ্ছে। নির্বিচারে আটকে রাখার ঘটনা বিরক্তিকরভাবে নিয়মিত হয়ে উঠছে। এমনকি বর্তমান শাসনামলে কঠোর সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের পরও এর বিধানের অধীনে নতুন মামলা দায়ের করা অব্যাহত রয়েছে, যা একটি উদ্বেগজনক এবং স্থায়ী বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।
এসময় ভয়েসের পক্ষ থেকে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে— আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা, যেন এসব আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ না করে। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর সহিংসতা ও হয়রানি রোধে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ যাতে আইন কখনোই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার না হয়। প্রেস কাউন্সিল ও অন্যান্য তদারকি সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যেন তারা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে এবং হুমকি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রাথমিক স্তর থেকেই অনলাইন আচরণ, লিঙ্গ সমতা ও তথ্য নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন ও অফলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর এবং কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নাগরিক ও ডিজিটাল অধিকার পর্যবেক্ষণে টাস্কফোর্স গঠন— যেখানে সরকার, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও প্রযুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়মিত বিশ্লেষণ ও সুপারিশ প্রদান করা হবে। নারীদের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, যাতে সব স্তরে নারীর সক্রিয় ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং সাংবাদিকদের জন্য সমন্বিত ও নিরাপদ মজুরি কাঠামো। যাতে তারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পায় এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক উদিসা ইসলাম, ইউএনডিপির সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির যোগাযোগ-বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শদাতা এস এম মনজুর রশিদ, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন এবং ওয়ান ফিউচার নেটওয়ার্কের ফেলো ও গবেষক মাহপারা আলম।
রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘এই প্রতিবেদনটি বর্তমান সময়ের সংকুচিত গণতান্ত্রিক ও নাগরিক পরিসরের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। তার মতে, এতে যে সুপারিশ ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে— তা শুধু গবেষণার আলমারিতে বন্দি না রেখে অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের টেবিলে পৌঁছাতে হবে।’
লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্য ছড়ানো রোধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ফেসবুক, টিকটকসহ বড় প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ গড়ে তোলার আহ্বান জানান মাহপারা আলম। তিনি বলেন, ‘যেসব কনটেন্ট লিঙ্গপরিচয়, শ্রেণি, জাত বা সংস্কৃতিগত কারণে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে অপমান করে তা দ্রুত শনাক্ত ও নামিয়ে নেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
মনজুর রশিদ বলেন, ‘ডিজিটালাইজেশনের ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জও। তিনি বলেন, ‘নাগরিক ও ডিজিটাল পরিসরে যে দমন-পীড়ন চলছে, তা মোকাবিলায় সমাজে যে নীরবতা বিরাজ করছে, সেটিকে ভাঙা দরকার।’
ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, ‘নারীদের অনলাইন ও জনপরিসরে অংশগ্রহণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতা। তাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদন্ড অনুযায়ী আইন তৈরি ও কার্যকর করার পাশাপাশি ডিজিটাল সাক্ষরতা ও নাগরিক শিক্ষাকে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত করতে হবে, তবেই জনপরিসওে গনতান্ত্রিকভাবে নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’