জাতীয় পরিচয়পত্রে পেশা হিসেবে লেখা রয়েছে গৃহিণী। নিজস্ব কোনও আয় নেই। কিন্তু বিলাসী জীবন কাটাতেন তিনি। নিজের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট, গাড়ি ও বাড়ি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ভূ-সম্পত্তি। খুলনায় বানিয়েছেন তিন তলা বাড়ি। ঘন ঘন ভ্রমণ করতেন বিদেশ। মালদ্বীপ তার প্রিয় জায়গা। সবই করেছেন স্বামীর দুর্নীতির টাকায়। এই নারীর নাম সাহেলা নাজমুল। তিনি বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হকের স্ত্রী। ছয় বছর আগে নাজমুল হক পাঁচ লাখ টাক ঘুষ নেওয়ার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে ধরা পড়েছিলেন। সেই মামলায় তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ডও দিয়েছিল আদালত। তখন সাহেলা নাজমুলও গিয়েছিলেন জেলে। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারামুক্ত হয়েছেন তিনি।
গত ৩০ জুন সাহেলা নাজমুলের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন দুদকের পরিচালক হাফিজুল ইসলাম। দুদকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাহেলা নাজমুল দুদকে যে সম্পদের বিবরণী জমা দিয়েছিলেন, তাতে অনেক সম্পদ গোপন করেছিলেন। তারা অনুসন্ধানের মাধ্যমে তার নামে থাকা সব সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পরে তা অভিযোগপত্রে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগপত্রের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ সাহেলা নাজমুলকে তার সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার জন্য দুদক থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল তিনি দুদকে সম্পদ বিবরণী জমা দেন। কিন্তু সম্পদ বিবরণীতে অনেক তথ্য গোপন করেন। সাহেলা নাজমুল তার সম্পদ বিবরণীতে এক কোটি ১০ লাখ টাকার স্থাবর এবং ৮০ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ বিবরণী জমা দেন। দুদকের অনুসন্ধানে এক কোটি ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৩ কোটি ২২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় দুই কোটি ৬৬ লাখ টাকার সম্পদ গোপন করেছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের ৩০ জুন দুদক কর্মকর্তা হাফিজুল ইসলাম বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
সাহেলা নাজমুলের যত সম্পত্তি
দুদকের অভিযোগপত্রে সাহেলা নাজমুলের সম্পত্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— খুলনায় ২ কাঠা জমিতে তিন তলা বাড়ি, ঢাকার বাড্ডায় ৫ কাঠা জমি, ঢাকার তুরাগে ১৬.৫ শতক জমি, রমনায় ৭০০ বর্গফুটের একটি দোকান, পূর্বাচলের রাজউক প্রকল্পে ১০ কাঠা জমি। এছাড়া মৃদুলা শাড়িঘর ও জামদানি কুটির শাড়িঘর নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে আটলান্টিক মেরিটাইম অ্যাকাডেমিতে কোটি টাকার শেয়ার, লামিরা জেনারেল ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে এক কোটি ৭০ লাখ টাকার বিনিয়োগ, তুরাগে ৩৩ শতাংশ জমি এবং রাজউক উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পে একটি ফ্ল্যাটের সন্ধানও পেয়েছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, সাহেলা নাজমুল ছাড়াও এই মামলায় অভিযোগপত্রে তার স্বামী ড. এস এম নাজমুল হককেও আসামি করা হয়। যদিও এই মামলায় নাজমুল হকের নামে কোনও সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যায়নি, কিন্তু স্বামী হিসেবে নাজমুলের যৌথ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন সাহেলা।
দুদক সূত্র জানায়, সাহেলা নাজমুল তার অবৈধ সম্পদ বৈধ করার জন্য বিভিন্নভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স ও ঋণ নেওয়ার তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করলেও এগুলোর সপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি। দুদকে দাখিল করা সম্পদবিবরণী এবং মামলা রুজু হওয়ার পর সংশোধনী রিটার্নে ঋণগ্রহণ সংক্রান্ত যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার কোনও গ্রহণযোগ্য বা প্রমাণযোগ্য রেকর্ডপত্র বা ব্যাংক চ্যানেল প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসামি নিজেও তদন্তকালে এসবের প্রমাণ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে এই ঋণগ্রহণের দাবিগুলো গ্রহণযোগ্য নয় বলে দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তদন্তকালে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র অনুযায়ী দেখা গেছে, আসামি সাহেলা নাজমুল ২০০৬-০৭ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত পারিবারিক ব্যয় হিসাবে ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ৫৬২ টাকা প্রদর্শন করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তার নামে ৩টি পাসপোর্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি সপরিবারে মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু ভ্রমণ ব্যয় তিনি আয়কর নথিতেও উল্লেখ করেননি।
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আসামি সাহেলা নাজমুলের স্বামী এস এম নাজমুল হক চাকরি করার সময় ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করার মানসে স্ত্রীর নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ দেখিয়ে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তার বিরুদ্ধেও চার্জশিট দাখিল করা হয়।