হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে

বছর গণনায় প্রচলিত দুটি পদ্ধতির একটির সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে, অপরটি সূর্যের সঙ্গে। সূর্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমরা যে বছর গণনা করি, সেটাকে খ্রিস্ট সাল কিংবা ঈসায়ী সন আখ্যা দেওয়া হয়, আর চাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত বছর গণনাকে আমরা বলি হিজরি সন।

মজার ব্যাপার হলো—দু’টি পদ্ধতির সঙ্গেই ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি ইসলাম ধর্মের বেশিরভাগ ইবাদতই আবর্তিত হয় চাঁদ ও সূর্যের ওপর নির্ভর করে। মানে—নামাজের ওয়াক্ত নির্ধারণ হয় সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী, রোজা শুরু ও শেষও হয় একই পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে রোজা ফরজ হয় রমজান মাসে, আর ওই মাস আবার নির্ধারিত হয় চাঁদের হিসাবের মাধ্যমে। হজ ও জাকাতের সময়ও ঠিক হয় অনুরূপ হিসাবেই।

পবিত্র কোরআনেও সূর্য ও চাঁদের হিসাবের গুরুত্ব বর্ণনা করে আয়াত নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) এবং হজের সময় নির্ধারক।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৯)

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শন বানিয়েছি। অতঃপর রাতের নিদর্শনকে অপসারিত করেছি আর দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকিত, যাতে তোমরা নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং জানতে পারো বছরের গণনা ও (মাসের) হিসাব।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ১২)

হিজরি বছর গণনা শুরু হয় মহানবী (সা.)-এর হিজরতের দিন থেকে। হজরত ওমর (রা.) তার খিলাফতকালে হিজরতের ১৭তম বর্ষে এটি গণনা শুরু করেন। হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসতো। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা থাকলেও সনের নাম লেখা থাকতো না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো। তখন পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সন নির্ধারণ ও গণনার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন উপলক্ষ থেকে সন গণনার মতামত এলেও শেষ পর্যন্ত হিজরতের ঘটনা থেকে সন গণনার সিদ্ধান্ত হয়।

সন গণনার আলোচনার সময় প্রস্তাব উঠেছিল, ঈসায়ী বা খ্রিস্ট বর্ষের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে নবীজীর জন্মের বছর থেকে ইসলামি বর্ষের শুরু হওয়া। এ রকম আরও কিছু কিছু উপলক্ষের কথাও আলোচিত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয় হিজরতের সন থেকে বর্ষ গণনার।

এক্ষেত্রে হিজরতের সময়কে বেছে নেওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো—হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় ‘আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী হিসেবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ-গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল। আরও বেশকিছু তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

আর খ্রিস্ট সালের মতো হিজরি বর্ষেরও মাসের সংখ্যা ১২টি। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট আল্লাহর বিধানে মাসের সংখ্যা ১২— সেই দিন থেকে, যেদিন তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস (বিশেষ) মর্যাদাপূর্ণ। এ-ই সরল দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)

পবিত্র কোরআনে হিজরি বর্ষের যে চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর নাম হাদিস শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘১২ মাসে এক বছর। এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক— জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম (মানে হিজরি ক্যালেন্ডারের সবশেষ দু’টি মাস ও প্রথম মাস)। আরেকটি হলো— রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মাঝের মাস।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৬৬২)

আর এসব মাসের বাইরেও আরেকটি অতি বিশেষ মাস আছে হিজরি ক্যালেন্ডারে, সেটি হলো—রমজান। এই মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। এজন্য আখিরাতের প্রাপ্তি মর্যাদা বিবেচনায় হিজরি বর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস এটি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

রমজান মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৭৯/২)

এ ছাড়া হিজরি বর্ষের পুরো ১২ মাসের মধ্যেও বিশেষ বিশেষ দিন আছে, আল্লাহর কাছে যেগুলোর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সেগুলোর অন্যতম হলো—মুহাররম মাসের ১০ তারিখ (আশুরা), শবে কদর, শবে বরাত, দুই ঈদের দিন, হজের দিন ইত্যাদি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও মাদ্রাসা শিক্ষক