জুলাই আন্দোলন: নেত্রীদের বয়ানে নারীদের অবদান ও বিস্মরণের গল্প

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে স্বৈরাচার পতনের একদফা আন্দোলন—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীরা ছিলেন সামনের সারিতে। রাজপথে, মিছিলে, সংগঠনে—সবখানেই নারীদের দৃপ্ত উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের সরব অংশগ্রহণ ছিল স্পষ্ট। রাজপথের মিছিলে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। শুধু মিছিলেই নয়, অনেক নারী ছিলেন যারা আন্দোলনকারীদের খাবার-পানির ব্যবস্থা করেছেন, আবার কেউ কেউ আহতদের সেবা-শুশ্রূষায় যুক্ত থেকেছেন। একেকজন নারী একেকভাবে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের গেট ভেঙে আন্দোলনে নামার ঘটনা তো ইতিহাসেই জায়গা করে নিয়েছে। ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীদেরও দেখা গেছে গেট ভেঙে রাজপথে নামতে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় বহু নারী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এরপরও আন্দোলনের দিনগুলোতে পুলিশি নির্যাতন কিংবা হামলার মুখে দাঁড়িয়ে নারীরা স্লোগান তুলেছেন, রাজপথে থেকেছেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশের জনগণ কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাদের এই ত্যাগ, অবদান কতটা মনে রেখেছে? তাদের স্বীকৃতি কতটুকু মিলেছে? বাংলা ট্রিবিউন কথা বলেছে জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির কয়েকজন নারী নেত্রীর সঙ্গে।

উমামা ফাতেমা

জুলাইয়ে নারী নেতৃত্বের দিক থেকে সামনের দিকেই আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার ১৪ জুলাইকে “জুলাই কন্যা দিবস” হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, এটা একটা স্বীকৃতি বটে। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের নথিপত্রে নারীদের সর্বস্তরের অংশগ্রহণের বিষয়টি ঠিকভাবে উঠে আসেনি। ৫ আগস্টের আগে নারীরা কিছুটা সম্মানিত হয়েছিল, কিন্তু এরপর সেই সম্মান অনেকটাই হারিয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী নারীদের সক্রিয়তা সহ্য করতে পারে না। তাই তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের নিয়ে কুৎসা ছড়ায়। এতে অনেক নারী আন্দোলন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’

নারী শহীদ ও আহতদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু সংবাদমাধ্যমে হয়তো রিয়া গোপের নাম এসেছে, তবে বড় পরিসরে নারীদের নিয়ে আলোচনা হয়নি। আহতদের পরিবারগুলোও সন্তানদের সামনে আনতে ভয় পায়। তারা ভাবেন, সামনে এলে হয়তো আরও অপবাদ বা হয়রানির শিকার হতে হবে।’

আশরেফা খাতুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম নারী নেত্রী আশরেফা খাতুন বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্র নারীদের স্বীকৃতি কীভাবে দিয়েছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আন্দোলনের পরপরই উপদেষ্টা হয়েছেন তিনজন ছাত্র, কিন্তু সেখানে কোনো নারী নেই। সংস্কার কমিশনগুলোতেও নারী প্রতিনিধিত্ব নেই।’

তিনি বলেন, ‘হয়তো এ বছর ১৪ জুলাই নারীদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হবে, কিন্তু এর আগে এক বছর প্রশাসন এ নিয়ে ভাবেনি। অথচ ১৪ জুলাইয়ের রাতে নারীদের হাত ধরেই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। আমাদের সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বরং আমরা দেখেছি, নারী নিপীড়নকারীদেরই ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে। এতে আমাদের মনে হয়, নারীদের নিরাপত্তা জুলাইয়ের আগেও ছিল না, এখনও নেই।’

তার ভাষায়, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নারীর রাজনীতি নিয়ে বুলি আওড়ালেও নারীদের মৌলিক মর্যাদার প্রশ্নে তারা নিরব। পুরুষ সহকর্মীদের মতো সমালোচনা নয়, নারীদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হয়। নারী শহীদদেরও কেউ মনে রাখে না।’

নাফিসা ইসলাম সাকাফি

অ্যাকশন ফর কমিউনিটি ট্রান্সফরমেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে নারীরা সামনে থেকেছে। ১৯৫২, ১৯৭১ বা ১৯৯০—সবখানেই। জুলাই আন্দোলনেও নারীরা বুক পেতে রাজপথে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তালা ভেঙে বেরিয়ে আসা ছিল সেই বিপ্লবের সূচনা। তবুও ইতিহাসে নারীর লড়াই অনুল্লিখিত থেকে যাচ্ছে।’

তার মতে, আজকের বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বকে পরিকল্পিতভাবে খাটো করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক সব স্তরে নারীদের গুরুত্বহীন করা হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রগঠনে নারীর ভূমিকা অপরিহার্য।

তিনি বলেন, ‘নারীদের জন্য নিরাপদ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তুলতে হবে। নারীর রাজনীতি শুধুমাত্র অংশগ্রহণ নয়, সম্মানও জরুরি। নীরবতা হলো ফ্যাসিস্টদের ভাষা। আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয়তাই মুক্তির পথ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই বিপ্লব আমাদের সামনে সুযোগ তৈরি করেছে—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল রাষ্ট্র গঠনের। যেখানে থাকবে না অন্যায়, গুম, খুন, উগ্রতা বা স্বজনপ্রীতি—থাকবে সংলাপ, জ্ঞান, সহাবস্থান ও উদারতা। বিপ্লব ব্যর্থ হলে আমরা শহীদদের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবো।’

সাদিয়া মাসুদ মম

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সদস্যসচিব সাদিয়া মাসুদ মম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর নারীরাই সবচেয়ে কম স্বীকৃতি পেয়েছে। মিডিয়া আমাদের নিয়ে তেমন কিছুই করেনি। সরকার কিংবা আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকেও আমাদের তেমন মূল্যায়ন মেলেনি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষও আমাদের মনে রাখেনি। তারা শুধু তাদের মনে রেখেছে, যারা আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে গিয়েছে, যারা নিয়মিত লাইভে আসে বা কথা বলে। নারী শহীদ ও আহতদের কথা বললে, ৫ আগস্টের পরপরই কোনও তালিকা আসেনি। কয়েক মাস পর ১১ থেকে ১২ জনের নাম আসে। আজও কয়জন নারী শহীদের নাম আমরা মনে রাখতে পারি? স্লোগানেও নারী শহীদদের নাম নেই।’

তার মতে, ‘জুলাই আন্দোলনে সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী হলো নারী আহতরা।’

নিশিতা জামান নিহা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক নারী নেত্রী নিশিতা জামান নিহা বলেন, ‘নারীরা পুরো সময় মাঠে থেকেছে। রাজপথে লড়েছে। আবার যারা মাঠে নামতে পারেননি, তারাও নানা উপায়ে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর নারীদের নিয়ে নানা কথা হলেও, নারীদের নিরাপত্তা বা সুযোগ নিশ্চিত করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘যেসব নারী একটু সামনে এসেছে, তাদেরই বিভিন্নভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার করা হয়েছে। অনেক নারী এখনো নানা ধরনের হুমকির মুখে রয়েছেন।’