ঘাতকের নৃশংসতা

জুলহাজ-তনয়শুধু মাথা আর ঘাড় লক্ষ্য করে একাধিক কোপ। কোপের তীব্রতায় মাথার খুলি প্রায় দ্বিখণ্ডিত। আঘাতে তাদের দু’জনেরই স্পাইনাল কর্ড কেটে গেছে। এভাবেই জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়।
সোমবার বিকালে কলাবাগান থানার উত্তর ধানমণ্ডির তেঁতুলতলা গলির ৩৫ নম্বর বাসার দ্বিতীয় তলায় জুলহাজ মান্নান ও তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের পর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন কলাবাগান থানার এসআই মো. আনসার আলী।
বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘দু’জনের মাথায় কোপানো হয়েছে। সবগুলো ধারালো অস্ত্রের আঘাত। ঘাড়, চিবুক, মাথার সামনে-পেছনে ও ওপরের অংশে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে ঘটনাস্থলে।’
আরও পড়ুন: জুলহাজ-তনয় হত্যার দায় স্বীকার আল কায়েদার

সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলহাজের মাথার পেছনে ও চিবুকের বাঁ দিকে ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ধারালো কোপের চিহ্ন রয়েছে। আঘাত এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, খুলি কেটে মগজ বের হয়ে এসেছে। মাথার পেছনে ডান দিকে কানের ওপরের অংশে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ চামড়া ও মাংস এবং খুলিসহ কেটে ঝুলে আছে।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘তার বাম হাতের মধ্যভাগে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেটে গেছে।’

এস আই মো.আনসার সুরতহাল প্রতিবেদনে বলেন, ‘তনয়ের মাথার পেছনের অংশ থেকে ঘাড় হয়ে প্রায় এক ফুট পরিমাণ জায়গা চার ইঞ্চি গভীর হয়ে কেটে গেছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। এছাড়া মাথার উপরের অংশেও পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে,কোপের কারণে কেটে গেছে খুলি।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ নিহত দুইজনের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে আঘাত করা হয়েছে। আঘাত এতো তীব্র ছিল যে, দু’জনেরই স্পাইনাল কড কেটে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

ময়নাতদন্ত শেষে দু’জনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জুলহাজের লাশ নিয়ে আসা হয় কলাবাগানে এবং তনয়ের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরে তাদের বাসায়।

দুপুরে জোহরের নমাজের পর কলাবাগানে তেতুলগলির মাঠে জুলহাজের জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে নিহতের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘যারা হত্যা করতে এসেছিল তাদের কারও প্রাণের মায়া ছিল না বলে আমাদের ধারণা। তারা যেকোনও কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন প্রকৃত মুসলিম মনে করেন প্রতিটি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। মত প্রকাশের জন্য কাউকে হত্যা করার অধিকার নেই। আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমরা যেন বাকি সময় এটা বহন করতে পারি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতকাল থেকে তদন্তকারী সংস্থা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। তারা সবাই আন্তরিক। সরকার সঙ্গত কারণেই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের হত্যার বিচার করবে। আমরা পরিবার থেকেও এর বিচার চাইবো এবং বিচার পাব। আমরা বিশ্বাস করি,অপরাধীরা ধরা পড়বে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। যাতে তারা আর কোনও মায়ের সন্তান বা কোনও ভাইকে হত্যা করতে না পারে।

মিনহাজ মান্নান বলেন, লাশ প্রথমে তাদের গুলশান বাসায় নেওয়া হবে। পরে বাদ আছর বনানী কবরস্থানে জুলহাজের মরদেহ দাফন করা হবে।

অারও পড়ুন: সব হত্যাকাণ্ড এক সূত্রে গাঁথা নয়: আইজিপি

৩৫ নম্বর বাসায় ঢুকতেই বামপাশের একটি ভবনের নীচতলায় ‘মীম ফ্যাশন লেডিস টেইলার্স’। দোকানটির মালিক ইয়াসমীন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার সন্ধ্যার আগে দোকানে এক কাস্টমার ছিল। তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় ডাকাত-ডাকাত,বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকার শুনতে পাই। আমি ভেবেছি হিজড়াদের মধ্যে কোনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কারণ ওই বাসায় প্রায়ই হিজড়া আসে। এরপর দেখি কয়েকটা ছেলে দৌঁড়ায়, তাদের ধরার জন্য পেছন দিক থেকে তিন চারজন চেষ্টা করছেন।এমন সময় কে একজন বলে উঠেন,পিস্তল-পিস্তল।তখন আমি দোকানের সাটার আটকে দেই। এরপর কি হয়েছে আর জানি না।’

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগানে খুন হন ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাজ মান্নান (৩৫) ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় (২৮)। নিহত জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই। জুলহাজ বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। ‘রূপবান’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি।তনয় আশা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করতেন। লোকনাট্য নামের একটি থিয়েটারের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

/এআরআর/ এমএসএম /