আর এলাকার কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরান বলছেন, আমাদের লোক আছে সব জায়গায়, যেকোনও দরকার হলে তারা কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘এখানকার বাসিন্দারা যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে যে যার মতো পছন্দের জায়গায় করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, সেহেতু এখন কত সংখ্যক শনাক্ত হচ্ছেন বা হচ্ছেন না, সেটি আমরা বলতে পারবো না।’
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছিলাম, এলাকাভিত্তিক লকডাউন করে করোনা প্রকোপ কমানো যাবে না। আক্রান্তের সংখ্যাগত জায়গায় আবারও আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে শতভাগ।
সোমবার (৬ জুলাই) বিকালে পূর্ব রাজাবাজারের গ্রিন রোডের আইবিএ হোস্টেল সংলগ্ন ফটক (নাজনিন স্কুল গেট হিসেবে পরিচিত) দিয়ে এলাকার প্রবেশ পথেই দেখা গেছে, সড়কের পাশে বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষ একসঙ্গে বসে কথা বলছেন। এসময় সড়কে যানবাহনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও ভিড় ছিল।
একটু সামনে গিয়ে নাজনিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে বেশ কয়েকজন যুবককে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাদের কারও মুখে মাস্কও দেখা যায়নি। যুবকদের একজন সৈকত। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্কুল বন্ধ। বাসায় সময় কাটে না। তাই বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিচ্ছি। একটু পরে আবার বাসায় চলে যাবো।’
এসময় এলাকার প্রধান সড়কে (মসজিদ গলি) মানুষের অবাধ চলাচল দেখা গেছে। দোকানপাটও খোলা ছিল। সড়কে ভ্যান সার্ভিসের মাধ্যমে সবজি বিক্রি হতেও দেখা যায়। তবে এলাকার বেশিরভাগ জায়গায় কাউকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘যে কয়দিন লকডাউন ছিল, ঠিক সেই কয়দিন কড়াকড়ি দেখা গেছে। এখন কেউ আসেও না, কোনও কিছু দেখেও না। দোকানপাটে কোনও স্বাস্থ্যবিধি নেই। এলাকার যুবকরা রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছে। কাউন্সিলর অফিস থেকেও কোনও তদারকি করা হচ্ছে না।’
পূর্ব রাজাবাজারকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে পরীক্ষামূলক লকডাউন কার্যকর করার ঘোষণা করা হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। আইইডিসিআরের হিসাব অনুযায়ী, সেসময় পূর্ব রাজাবাজারে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছিল ৩৯ জন। আর তিন সপ্তাহ পর লকডাউন শেষ হওয়ার আগে ২৭ জুনের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব রাজাবাজারে কোভিড-১৯ রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ জনে, অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
রাজাবাজারে কঠোর লকডাউনের পরেও সংক্রমণ কেন থামানো যায়নি, ভালোভাবে সেটা স্টাডি হওয়া জরুরি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানায়, রাজাবাজারে লকডাউনের শেষ দিনে ১৮ জনের মধ্যে ১১ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের ভেতরে কী করে ১৮ জনের ভেতরে ১১ জন পজিটিভ হলেন, সেটা নিয়েও এখন জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা দরকার। তাহলে কি এলাকাভিত্তিক লকডাউন আদৌ কোনও কাজে আসছে না? কেন লকডাউনের সময় রোগী সংখ্যা সেভাবে কমলো না, সেটা দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার, বলেছে অধিদফতরের একাধিক সূত্র।
বর্তমানের হিসাব কার কাছে?
রাজাবাজার আমাদের ভালো শিক্ষা দিয়েছে মন্তব্য করে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিউনিটি ইনভলবমেন্ট কাজে দিয়েছে, যেখানে কিনা জনবলের অভাব থাকলেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী খুঁজে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। যখন ১৭ দিনের লকডাউন শেষ হচ্ছিল, তখনও নতুন শনাক্ত পাওয়া যাচ্ছিল। এ কারণে এলাকার মানুষ নিজেরাই বেষ্টনী প্রত্যাহার করার পক্ষে মত দেয়নি।’ মোট রোগী কত পাওয়া গেলো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা কাউন্সিলর সাহেব ঘোষণা দেবেন।’
যদিও কোনও নতুন রোগী নেই বললেও কাউন্সিলর জানেন না বর্তমানে এলাকার অধিবাসীরা কে কোথায় টেস্ট করাচ্ছেন। এমনকি রাজাবাজারে মোট কত রোগী হলো শেষমেশ তেমন কোনও হিসাবও তিনি দিতে পারেননি। জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিল ফরিদুর রহমান ইরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লকডাউনের পর রাজাবাজারে আক্রান্তের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তবে লকডাউন চলাকালে এই এলাকায় ৪০০ জনের মতো স্থানীয় বাসিন্দার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৫ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে।’
লকডাউনের পর কতজনের করোনা পরীক্ষা হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে এলাকায় এখনও নমুনা সংগ্রহের বুথ রয়েছে। অনেকেই আবার এর বাইরে গিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালসহ অন্যান্য স্থানেও পরীক্ষা করাচ্ছেন। যতদূর জানি, এই সময়ে যে সংখ্যক মানুষের নমুনা সংগ্রহ হয়েছে, তার মধ্যে আক্রান্ত নেই বললেই চলে। তবে সঠিক তথ্য জানা নেই। কারণ, লকডাউনের পর এ নিয়ে আইইডিসিআরের সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হচ্ছে না।’
কাউন্সিলর আরও বলেন, ‘লকডাউন শেষ হওয়ার পরেও যেসব বাড়িতে করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিলেন, সেসব বাড়িতে কড়াকড়ি ছিল। তবে এখন আক্রান্ত নেই বললেই চলে। সেকারণে কোনও বাড়ি এখন আর লকডাউন বা কড়াকড়ি নেই। তবে আমাদের কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছেন। যে কোনও প্রয়োজনে তারা মাঠে কাজ করবেন।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বারবারই আমরা বলেছি, এভাবে লকডাউন দিয়ে এলাকাকে লাল থেকে হলুদ জোনে এনে ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, বাইরেরটা খোলা এবং ২২তম দিনে বাইরের সঙ্গে যখন লকডাউন এলাকার মানুষের মিথস্ক্রিয়া ঘটবে, তখন সেই আগের পরিস্থিতিই তৈরি হবে। তাহলে এধরনের লকডাউনে লাভটা কী? এবং যখন কিনা পরীক্ষামূলক লকডাউন করছি কোন জায়গায়, সেটা কতটা সফল হলো, সেই তথ্যটাও কিন্তু মানুষকে জানাতে হবে।’