শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন বন্ধে কওমি মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি

শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে কওমি মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।  বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এই দাবি জানানো হয়।

ওয়েবিনারে বক্তরা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসায় নজরদারি না থাকার কারণে সেখানে একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্য নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রতিষ্ঠিত এইসব প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হচ্ছে, জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে কিনা, সরকারি দিবসগুলো পালিত হচ্ছে কিনা এবং সর্বোপরি এখানে পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা কোথায় যাচ্ছে, এসব নিয়েও জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনও আলোচনা নেই।

বক্তরা বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে কওমি মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কীভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কওমি মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন সেইসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম এ আউয়াল হাওলাদার বলেন, ‘নিপীড়ন বন্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে। আমাদের মানসিকতা ও নৈতিকতার পরিবর্তন ঘটানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।’

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের  প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘বেশিরভাগ শিশুধর্ষণের ঘটনা ঘটে কওমি মাদ্রাসায়। সেসব মাদ্রাসা আবাসিক। অন্য জায়গাতেও হচ্ছে। আলিয়া মাদ্রাসায় খুবই কম হয়।  পুরুষশিশু নির্যাতনের বিষয়টি আইনে স্পষ্ট হওয়া যেমন দরকার, তার চেয়ে আইনের প্রয়োগ বেশি প্রয়োজন। কেন শিশু নির্যাতনের অভিযোগ করেও আবার বলছে হয়নি, তা জানা দরকার।’

অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘সচেনতা বাড়াতে হবে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কারিকুলাম নিয়ে কাজ করতে হবে। কারিকুলাম মানুষ চোখে দেখে না, বই চোখে দেখে, সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে টিচিং অ্যান্ড লার্নিংয়ে।  সেলফ ডিফেন্স শেখাতে হবে শিশুদের।  রাজনৈতিক ইন্টারফেয়ার থাকা যাবে না।  নির্দশনা দিতে হবে এবং নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে জরুরি মোটিভেশন পলিসি গ্রহণ করতে হবে।  প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি করে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ৯৯৯ নম্বরে অভিযোগ করার সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীর সুবিধাজনক জায়গায় অভিযোগ বক্স রাখতে হবে।  আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের  প্রধানকে সার্বক্ষণিক প্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সঙ্গে অভিভাবকদের যোগাযোগ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সিভিল সোসাইটি, এনজিও ও গণমাধ্যমকে কাজ করতে হবে এবং জনমত তৈরি করতে হবে।’

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নির্যাতন বেশি হচ্ছে।  কওমি ধারার আবাসিক মাদ্রাসায় থেকে লেখাপড়া করতে হয়। এখানে যেসব শিক্ষার্থীরা আসে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিম্নমানের।’

সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘স্বাধীন দেশে কত ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে? ব্যাংকের ছাতার মতো বাসাভাড়া নিয়ে যেসব মাদ্রাসা গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে কী কারিকুলাম পড়ানো হয়, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।  যত নির্যাতন হয় কয়টি ঘটনা আলোর মুখ দেখে, কয়টি মিডিয়ায় আসে?’

সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকা প্রতিষ্ঠান কওমি মাদ্রাসার বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীন দেশে এমন প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত নয়, যে প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে না।  জাতীয় দিবস পালন করবে না, একটি দুর্গের মতো প্রতিষ্ঠান— যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কোনও জবাবদিহি থাকবে না— এই ধরনের প্রতিষ্ঠান স্বাধীন দেশে হওয়া উচিত নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার চেষ্টা করছে এই ধারার মাদ্রাসাগুলোকে একটি সিস্টেমে আনার জন্য।  তবে এখনও পর্য়ন্ত তা সুদূর পরাহত।  আলিয়া ধারার মাদ্রাসায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যেভাবে সারা দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু কওমি মাদ্রাসায়  নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটছে, সেগুলো কেনও জানি একটু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।  মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা একটি আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কেউ চাইলেই যেখানে সেখানে মাদ্রাসা তৈরি করতে পারবে না।  সরকারের অনুমোদন নিতে হবে এবং এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এই বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে।  এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।  বিভিন্ন ডাইমেনশনের যে মাদ্রাসা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে তা নিয়ন্ত্রণ করার এখনই সময়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন,‘শুধু মাদ্রাসাতেই নয়, ২০২০ সালে ৭০০ ক্যাথলিক ধর্মগুরু এবং থাইল্যান্ডে মংকদের বিরুদ্ধের যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষেরই উচিত হবে এখন তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেওয়া। নয়তো তাদের প্রতি মানুষের ধারণার পরিবর্তন ঘটবে। মাদ্রসার ছাত্ররা যেন অভিযোগ দায়ের করতে পারেন, এজন্য একটি কমিটি থাকা উচিত। অভিযোগ বক্স থাকতে হবে।’

ওয়েবিনারে আরও যুক্ত ছিলেন— আইন সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী আব্দুস রশীদ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের  সহকারী পরিচালক মোশরাকুল আলম, রস্ক প্রজেক্ট এবং ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের রোকসানা সুলতানা। 

অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এমজেএফ-এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর অর্পিতা দাস।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই শাহীন আনাম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি জবাবদিহির সংস্কৃতির আওতায় আনতে হবে। বাবা মা বিশ্বাস করে তাদের শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠান, সেখানে যদি এইভাবে নিপীড়নের শিকার হয়, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়।”