ডিএসসিসির মার্কেট

ভেঙে দেওয়া দোকান ফের নির্মাণ করে দখল

নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মিত রাজধানীর গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ও জাকের সুপার মার্কেটের সহস্রাধিক দোকান উচ্ছেদ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু উচ্ছেদের মাসখানেক পরই আবার সেখানে দোকান তুলে ব্যবসা শুরু করছেন অবৈধ দখলদাররা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মার্কেট কমিটির কথিত নেতা ফিরোজ আলম এবং ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজসেই দোকানগুলো আবার তোলা হচ্ছে। ফিরোজ আলমকে স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের দুই নেতা প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ থেকে প্রতিমাসে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। এমনকি করপোরেশন থেকে দোকানগুলোর বৈধতা এনে দেওয়ার কথা বলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে।

গত ডিসেম্বরের অভিযানে এসব দোকান ভেঙে দেওয়া হলেও মাসখানেক পর আবারও সেখানে নির্মাণকাজ শুরু করে দখলদাররা। ভেঙে দেওয়া প্রতিটি দোকানই পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে। চলছে বেচাবিক্রিও। ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ও জাকের সুপার মার্কেটে নির্মাণ কাজ দেখা না গেলেও উচ্ছেদ হওয়া স্থানে দোকান বসাতে দেখা গেছে।

নির্মাণ চলছে গভীর রাতে

মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ-তারা সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমানের সময় থেকেই সম্পত্তি বিভাগ থেকে বরাদ্দ পেয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। সে সময় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বরাদ্দ বাতিলও করেছে। কিন্তু তারা কোর্টে মামলা করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। সর্বশেষ আদালতের রায়ে ডিএসসিসির সাবেক প্রশাসন ১০-১২ বছরের বকেয়া গ্রহণ করে তাদেরকে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন তাদের দোকান ভেঙে দিয়ে উচ্ছেদ করে।

সরেজমিন দেখা গেছে, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার সিঁড়ি সংলগ্ন ভেঙে দেওয়া অর্ধশতাধিক দোকান ইটপাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ভেতরের অন্যান্য স্থানে নির্মিত দোকানগুলোর নির্মাণকাজও চলছে। মার্কেটের বৈধ দোকানিরা বলছেন, অভিযানের মাসখানেক পর গভীর রাতে দোকানগুলো আবার নির্মাণ করা হতো। সম্প্রতি লকডাউন ঘোষণার পর যখন দোকানপাট বন্ধ ছিল তখন পুরোদমে শুরু হয় অবৈধ নির্মাণকাজ।

একই চিত্র দেখা গেছে, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ও জাকের সুপার মার্কেটে। মার্কেটে বেজমেন্ট থেকে শুরু করে তৃতীয় তলার পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া দোকানগুলোতে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। মার্কেটের নিচেও পণ্যের পসরা সাজিয়ে দোকান বসিয়েছেন কয়েক শত দোকানি।

লকডাউনের পর আবার উচ্ছেদ হবে

দোকান ভেঙে দেওয়ার পর আবার ব্যবসা করছেন কী করে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কেটের তৃতীয় তলার এক জুতার দোকানি বলেন, ‘মার্কেট কমিটি থেকে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে এই দোকান কিনেছি। তারা বৈধ করে দেবেন বলেছেন। পরে সিটি করপোরেশন আবার ভেঙে দিয়েছে। এখন আবার আরও ২৫ হাজার টাকা ভাড়ায় মার্কেট সমিতি থেকে দোকানগুলো নিতে হয়েছে। তারা বলেছে- সিটি করপোরেশনকে টাকা দিতে হবে। না হয় ব্যবসা করতে দেবে না।’

সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার দোকানের ঠিক সামনের সিঁড়ির গোড়ার ফাঁকা জায়গায় ৫টি অবৈধ দোকান ভেঙে দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু মাসখানেক পরই দেখি দোকানগুলো আবার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর কারণে আমরা যারা বৈধ ব্যবসায়ী তারাও দোকান করতে পারছি না। ওরা আবার মার্কেট সমিতির লোক। তাদের কিছু বললে ব্যবসা করতে পারব না।’

ডিএসসিসির মার্কেটটি পড়েছে ৩৪ নং ওয়ার্ডে। জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে অভিযানের পর ভেঙে দেওয়া সব দোকান আবার নির্মাণ করা হচ্ছে। মার্কেট কমিটির নেতারা বিভিন্ন জনের নাম ব্যবহার করে এসব করেছেন। বিষয়টি মেয়রকে জানিয়েছি। লকডাউনের কারণে সেখানে উচ্ছেদ করা যায়নি। লকডাউন চলে গেলে আবার উচ্ছেদ করা হবে।

জানা গেছে, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২-এর ব্লক-এ, বি ও সি-তে এবং বিভিন্ন তলায় পরিত্যক্ত গ্যাপে এক লাখ ২০ হাজার ৬৩১ দশমিক ৩৬ বর্গফুট জুড়ে ৫৫৫টি দোকান ২০১২ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রশাসক খলিলুর রহমানের সময় এ জায়গার প্রতি বর্গফুট মাসিক ২০ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২৬ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়ে করপোরেশনের সার্ভেয়ার সৈয়দ রুমান ও মুহাম্মদ মুরাদ হোসেন বরাদ্দগ্রহীতাদের কাছে দখল হস্তান্তর করেন। একই বছরের ৩১ মে ওই বরাদ্দ আদেশ বাতিল করেন পরের প্রশাসক। বিষয়টি নিয়ে তখন মার্কেট সমিতি আদালতে মামলা করে। মামলার কারণে তখন এসব দোকান উচ্ছেদ করতে পারেনি প্রশাসন। মামলাটি এখনও চলমান।

এ অবস্থায় মার্কেট কমিটির কথিত সভাপতি দোলোয়ার হোসেন দিলু ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বাতিল হওয়া সেসব দোকান থেকে ভাড়া আদায় ও ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের আবেদন করেন। আবেদনটি দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন ছিল। পরে আবেদনটি সিটি করপোরেশনকে আমলে নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করেন তিনি। আদালত তার আবেদনটি আদেশ প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন।

আদালতের নির্দেশের পর বিষয়টি সিটি করপোরেশনের সপ্তদশ ‘করপোরেশন সভায়’ উত্থাপন করা হয়। সভায় কাউন্সিলররা প্রস্তাব করেন, বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী মার্কেট বা দোকান গড়ে উঠেছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব দোকান থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করা হয়। কিন্তু আদায়কৃত অর্থ করপোরেশন তহবিলে জমা হয় না। উক্ত অস্থায়ী মার্কেট বা দোকানের ভাড়া ও ট্রেড লাইসেন্স ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে মার্কেটগুলোকে বৈধতা দিয়ে বকেয়া পরিশোধসহ অস্থায়ী ভিত্তিতে ভাড়া আদায় ও ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

ডিএসসিসির তৎকালী প্রশাসন এসব দোকানপাটে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন দেয়। একইভাবে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের ৩৪টি দোকানের ভাড়া আদায় করে ডিএসসিসি। সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমানের সময়ে এই মার্কেট নকশা বহির্ভূত ৭৫৭টি দোকান নির্মাণ করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সমিতির নেতা ফিরোজ আলম ফোন ধরেননি। বিষয়টি উল্লেখ করে এসএমএস পাঠালেও কোনও সাড়া দেননি তিনি।

কথা বলতে রাজি হননি ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনও। বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলার জন্য তাকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।