জমানো টাকা শেষ, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে পরিবহন শ্রমিকদের

বাস চলাচল বন্ধ, তাই কোনও ইনকাম নেই। জমানো টাকা এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। পেটের ক্ষুধা মিটাতে এখন একের পর এক বিক্রি করে চলছেন বউয়ের স্বর্ণালংকার। এখন পর্যন্ত পাননি কোনও সরকারি বা সাংগঠনিক সহযোগিতা। ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন পরিবহন শ্রমিক মুজিবুর রহমান। গত সোমবার গাবতলী বাস টার্মিনালে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। 

তিনি বলেন, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন চলাচল। বাস চললে আমাদের পেটে ভাত জোটে, পরিবারের মুখে হাসি আসে। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। বসে থেকে জমানো প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা শেষ করে ফেলেছি। এখন বউয়ের স্বর্ণালংকার বিক্রি করেছি। বিক্রি করতে করতে এখন বাকি আছে বউয়ের একটি স্বর্ণের চেইন এবং বালা। ভাবছি, এগুলো বিক্রি করে বাসার পাশে একটি মুদির দোকান দেবো। শেষ চেষ্টা করবো বেঁচে থাকার।

ক্ষোভের সঙ্গে মুজিবর বলেন, ‘দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টতায় যারা আছেন তারা নিজেদের আখের গোছানোর কাজে আছেন।’

একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন পরিবহন শ্রমিক আমিনুল। তিনি বলেন, ‘আমরা যে কত কষ্টে আছি, আপনারা তা ভাবতেও পারবেন না। কার কাছে যাবো, কার কাছে সাহায্য পাবো- কিছুই জানি না। মালিকদেরই বা কি বলবো, তাদেরও তো ইনকাম নাই। পরিবহন কল্যাণ ফান্ড একটা আছে, সেটা যে কাদের জন্য বলতে পারবো না। আমরা সেখান থেকে কোনও সাহায্য পাইনি। নেতাদের কাছাকাছি যারা থাকে, তারাই কেবল কিছু পাচ্ছে বলে শুনেছি।’

গাবতলী টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, পরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। অনেকে আবার করছেন গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ। এর বাইরে আর কি কাজ করছেন জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিক আলামিন বলেন, ‘আমরা আর কী করবো ভাই। আর কোনও কাজ তো জানি না। এখানে পড়ে থাকি। গাড়িগুলো দেখাশোনা করি। গাড়িতেই থাকি, পাশে হোটেলে খাই। মালিক কিছু খোরাকি দেন, তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

টার্মিনালের একপাশে চলছিল রান্না। চোখ যায় সেদিকে। সেখানে গিয়ে কথা বলতেই জোর আপত্তি তাদের। বললেন, ‘ভাই ছবি তুলে বা সংবাদে দেখিয়ে কোন কাজ হবে না। অনেকে ছবি তুলে নিয়ে গেছে। সংবাদও প্রচার করেছে। কিন্তু তাতে আমাদের তো কোন লাভ হয়নি। কেউ এগিয়ে আসেনি আমাদের সহায়তা করতে।’

পরে ধীরে ধীরে ক্ষোভ কিছুটা কমে। জানায়, অতি কষ্টে কাটেছে তাদের জীবন। মানসিকভাবেও হয়ে পড়েছেন অসহায়। কমফোর্ট পরিবহনের মালিক গাড়ি দেখাশোনার জন্য ৬/৭ জনকে টার্মিনালে রেখেছেন। আর তাদের প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে খরচ দেন খাদ্যের জন্য। এই এক হাজার টাকা দিয়ে তারা বাজার থেকে শাকসবজি, মাছ, ডাল চাল কিনে আনেন। টার্মিনালের এক কোনায় নিজেরাই রান্না করেন। এভাবেই চলছে তাদের বর্তমান সময়।

কমফোর্ট পরিবহনের চালক আলমগীর বলেন, ‘লকডাউনের পর থেকেই গাড়ির মালিক আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন, করে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে আমাদের গ্যাস সিলিন্ডার এবং একটি চুলা দিয়েছেন রান্নাবান্নার জন্য। আমরা এখন এক বেলা রান্না করি, দুই বেলা খাই।’

বাড়িতে যে পরিবার রয়েছে, তাদের অবস্থা কি জানতে চাইলে কিছু সময় চুপ করে থাকেন। একটু পর আস্তে করে বলেন, ‘জানি না, ভাই। পরিবারের অবস্থা আর কি বলবো। ওরা কষ্ট করে চলছে। আমি নিজে আপাতত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। আসলেই ভাই আমরা অনেক কষ্টে আছি। আমাদের দেখার কেউ নেই।’

গাবতলী বাস টার্মিনালে পুরি সিঙ্গাড়া বিক্রি করছিলেন কবির। তিনি বলেন, ‘এখানে যে সকল শ্রমিক থাকেন, তাদের অনেকেই দুবেলা ভাত খেতে পারে না। একবেলা ভাত খেলে আরেক বেলা চার-পাঁচটা পুরি ও পানি খেয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। এখানে এরকমই দেখছি। আর আমিও তিন মাস ধরে এখানে কাজ করে শুধু নিজেরটাই চালাতে পারছি। পরিবারকে কোনও টাকাই পাঠাতে পারছি না। পরিবার কীভাবে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ চালাচ্ছে। এমন একটা অবস্থা, কারও কাছে যে চাইবো, তারও কোনও জো নেই।’