অনুমোদন ছাড়াই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে ডিএনসিসি

দেশের সিটি করপোরেশনগুলো তাদের আওতাধীন বিভিন্ন ব্যবসা, বৃত্তি, পেশা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের ফি আদায় করে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত আদর্শ কর তফসিল-২০১৬ অনুযায়ী। আদর্শ কর তফসিলে লাইসেন্স ও নবায়ন ফি, সাইনবোর্ড কর, বিজ্ঞাপন ফি ও সারচার্জ ফি এবং এর পরিমাণের কথা উল্লেখ আছে। ট্রেড লাইসেন্সে ফির সঙ্গে ‘অন্যান্য ফি’ নামে কোনও ফির কথা উল্লেখ নেই এই প্রজ্ঞাপনে।

প্রজ্ঞাপনে না থাকলেও ‘অন্যান্য ফি’ নামে ট্রেড লাইসেন্সে একটি অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের খাত নির্ধারণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। আর এই খাতে ৫০০ ফি টাকা নির্ধারণ করে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই আদায় করছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। 

জানা গেছে, জমা করা অর্থের ওপর ১৫ ভাগ চালানের মাধ্যমে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অন্যান্য ফির খাতে আদায় করা অর্থের ওপর ভ্যাট জমা দেওয়া হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের অনুমোদন ছাড়া সিটি করপোরেশন কর্তৃক এ ধরনের ফি আদায় বেআইনি।

এ বিষয়ে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য ফি একটি অস্পষ্ট কথা। আগে সিটি করপোরেশনকে পরিষ্কার করে বলতে হবে এটি কোন সেবা দেওয়ার জন্য নেওয়া হবে। আর এ ফি আদায়ের আগে অবশ্যই সরকারের অনুমোদন লাগবে কারণ এসব ফি প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত। এর বাইরে গেলে অবৈধ হবে।’

ডিএনসিসি-তে মোট ট্রেড লাইসেন্স গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এই গ্রাহকদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কী সেবার বিনিময়ে এই টাকা আদায় করা হবে, তার সদুত্তর নেই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের কাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লাইসেন্স গ্রহীতা বলেন, ‘আমাদের ছোট দোকানের লাইসেন্স ফি ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য ফি হিসেবে ৫০০ টাকা বাড়ালে আমাদের মতো লোকদের জন্য লাইসেন্স করা কঠিন হয়ে যাবে। কেন ৫০০ টাকা বেশি নিচ্ছে, সেটাও তো বুঝলাম না।’

ডিএনসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রেড লাইসেন্স অনলাইনে প্রদানের সেবামূল্য নির্ধারণ করার সময় এ নতুন খাত যুক্ত করে ৫০০ টাকা আদায় করছেন তারা। পাশাপাশি তারা ট্রেড লাইসেন্স বইয়ের দামও বাড়িয়েছেন। প্রতিটি ট্রেড লাইসেন্সের ক্ষেত্রে প্রিন্ট, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২৭০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। ডিএনসিসির দ্বিতীয় পরিষদের ১৪তম করপোরেশন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ট্রেড লাইসেন্স বিবিধ ফি বাবদ ৫০০ টাকা অনলাইনের মাধ্যমে আদায়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।

গত ৪ অক্টোবর এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই আর্থিক বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের আগেই আদায় শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ দেশের কোনও সিটি করপোরেশনই এই ধরনের কোনও খাতে টাকা আদায় করে না।

জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক টাকা কমাতে গেলেও সরকারের অনুমোদন লাগে। আবার বাড়াতে গেলেও সরকারের অনুমোদন লাগে।

স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ ( সিটি করপোরেশন) এর ৮২ ধারায় বলা আছে, করপোরেশন, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, প্রবিধান দ্বারা চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত সকল অথবা যে কোন কর, উপ-কর, রেইট, টোল ও ফিস ইত্যাদি আরোপ করিতে পারিবে। আর  ৮৩  (১) কর্পোরেশন কর্তৃক আরোপিত সমুদয় কর, উপ-কর, রেইট, টোল ও ফিস সরকারি গেজেটে প্রকাশ করিতে হইবে এবং সরকার ভিন্নরূপ নির্দেশ প্রদান না করিলে তাহা প্রাক-প্রকাশনা সাপেক্ষ হইবে (২) কোনও কর, উপ-কর, রেইট, টোল ও ফিস উহার অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে তারিখ হইতে কার্যকর হইবে বলিয়া নির্দেশ দিবে সেই তারিখ হইতে কার্যকর হইবে।

অথচ সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া কেন এই অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে জানতে চাইলে ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, 'সিটি করপোরেশনের সচিবের আইনগত কাজ হলো সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য অফিস আদেশ জারি করা। আমার কাছে অনুমোদন হয়ে আসার পর আমি জারি করি।' 

কেন আইনি বিষয়টি খতিয়ে না দেখে আদেশ জারি করা হলো জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কোন সিদ্ধান্ত আইনি আর কোনটা বেআইনি তা সচিবের জিজ্ঞাসা করার সুযোগ নাই। যেহেতু অনুমোদন হয়ে আসছে আমি জারি করেছি। এগুলো বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রতিটি জিনিস নিয়েই প্রশ্ন করতে হবে এ বিষয়ে মেয়র স্যার ও সিইও স্যার ভালো বলতে পারবেন।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অফিস আদেশের বলে এ টাকা আদায় করছি। সরকারের অনুমোদনের জন্য আমরা আবেদন প্রস্তুত করছি। আমরা ভূতাপেক্ষ অনুমোদন নেবো।’

সরকার প্রস্তাব গ্রহণ না করলে কী হবে, জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকার প্রস্তাব পাস না করলে আদায় করা অর্থ আমরা সমন্বয় করবো। এ সুযোগ আইনে আছে। তবে ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই। ৫০০ টাকার পর যে ট্যাক্স হবে, তা পরে জমা দেয়া হবে।’

কোন ধরনের সেবার বিনিময়ে এই ফি ধার্য করা হলো, জিজ্ঞেস করা হলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাকে জেনে বলতে হবে।