রমজানে রাজধানীতে মৌসুমি ভিক্ষুকের ভিড়!

কয়েক বছর ধরে রমজানকে সামনে রেখে রাজধানীতে বাড়ছে মৌসুমি ভিক্ষুকের সংখ্যা। এবারও ঢাকার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক ভিক্ষুক রাজধানীতে এসেছে। ঈদকে সামনে রেখে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য নগরীতে আসা লোকের সংখ্যা বাড়ছেই।

ঢাকায় নিয়মিত ভিক্ষা করেন এমন কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, রমজান এলেই রাজধানীতে থাকা বিভিন্ন স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের আত্মীয়দের নিয়ে আসেন খণ্ডকালীন ভিক্ষাবৃত্তির জন্য। অনেকে রমজানের একমাসের জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে বা আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এসে রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে দেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ ভিক্ষুকের লক্ষ্য থাকে অভিজাত এলাকা এবং এর আশপাশের ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা করা। এছাড়া স্থানীয় ছোট বড় মার্কেট ও মসজিদের সামনেও তারা নিয়মিত ভিড় করেন।336481674_1402168910520460_331525929896221491_n

এ বিষয়ে লালমাটিয়া এলাকায় নিয়মিত ভিক্ষা করা ইসমেত আরা (৫৪)বলেন, দেশের নানান জায়াগা থেকে ভিক্ষা করতে বহু লোক ঢাকা আসে। বরিশাল, ভোলা, ময়মনসিংহ এসব এলাকা থেকে বেশি আসে। স্বামী ঢাকায় রিকশা চালায় গ্রাম থেকে রমজানের সময় স্ত্রীরে নিয়ে আসে ভিক্ষা করাতে। এদের ব্যবসাই এটা। নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বাসায় থাকে তারা। আবার ভিক্ষা করতে একসাথে আসা কয়েকজন মিলেও ঘর ভাড়া নেয় এক মাসের জন্য।  

মৌসুমি ভিক্ষুকদের কারণে প্রকৃত অসহায়রা বঞ্চিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই লালমাটিয়াতেই কাজ করা মানুষ আমরা। এখন আর ভারী কাজ করতে পারি না তাই মানুষের কাছে দুই-চার টাকা সাহায্য নিয়া চলি। এখন আজান দিছে আসছি আবার আজান দিবে চলে যাবো। আসি পরিচিত মানুষজন যদি কিছু দেয়, জোর নাই। কিন্তু যারা রমজানের এক মাসের জন্য আসে তারা সারাটা দিন ঘোরে, ফাঁকে ফাঁকে পানি খাবে, বেশিরভাগই রোজা রাখে না। তারা সামনে পেলে পথাচারীকে ভিক্ষার জন্য বিরক্ত করে। তখন আমরা সামনে গেলে আর কেউ ভিক্ষা দিতে চায় না। ফিরায়া দেয়।’336495132_600999828280232_7701997926842004454_n

রমজানে মৌসুমি ভিখারিরা দৈনিক ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জমা করে জানিয়ে পান্থপথ-মিরপুর রোডের সিগন্যালে বসা শারীরিক প্রতিবন্ধী মেহেরুন (৪১) বলেন, আমরা দুইটা প্রাইভেট কারের সামনে যাইতে পারলে নতুন আসারা যাইতে পারে দশটার সামনে। পরে আমরা গেলে বলে— কয় জনারে ভিক্ষা দিমু। এরা একাই দিনে হাজার-দুই হাজার টাকা কামায়া নিয়া যায়। আমার তো পায়ে সমস্যা। আর যারা নতুন আহে তাগো শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, কোলে ছোট বাচ্চা নিয়া ঘোরে। জ্যাম লাগলেই দৌড়াইয়া সব গাড়িতেই যায়।

শুক্রাবাদ এলাকার আরেক ভিক্ষুক আবসার বলেন, ‘মসজিদগুলাতে রমজান আইলে লোক বাড়ে। এরা তো সারা বছর এইখানে থাকে না। শুক্রবার হইলে ওদের জন্য ঠিক মতো কারও কাছে থেইকা সাহায্য নিতে পারি না। রোজাতে মানুষ কম-বেশি দান-খয়রাত করে। কিন্তু চাওয়ার মানুষ বেশি হইলে তখন সবাইরে ভাগ দিয়া—সেই সারা বছরই যা পাই তাই। আর এরা তলে দিয়া ফাউ এক মাসের কামাই নিয়া যায়।’

তবে প্রয়োজন না হলে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নামেন না জানিয়ে মাসখানেক ধরে পান্থপথ-মিরপুর রোডের সিগন্যালে ভিক্ষা করতে আসা আবদুল আলি (৬৩) বলেন, ‘রমজানের সময় খরচ বাইড়া যায়। তাই মাঝে মাঝে আসি। সব সময় ভিক্ষা করি না।'336597975_1700970163655148_1972673903140822759_n

এদিকে রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তি ঠেকাতে সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন,  মৌসুমি ভিক্ষাবৃত্তিকে সামনে রেখে সরকারি এই দফতরের পক্ষ থেকে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপপরিচালক (ভিক্ষুক ও চা শ্রমিক) মো. শাহ জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত রাখতে প্রতিনিয়তই আমরা মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এবার রমজানে প্রতিদিনই আমাদের এই কার্যক্রম চালু থাকবে। তাছাড়া আমরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিরুৎসাহিত করতে আরও প্রচার-প্রচারণা বাড়াবো। গত কয়েকটি বছর ছাড় দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এবছর রমজানে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়াও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।  

সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দেশে দারিদ্র্য নিরসনে ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ২০১০ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নেয়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, কর্মসূচি শুরুর সময় থেকে বর্তমান সাল পর্যন্ত ৪২৬৪.৩৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এবং এই কর্মসূচি থেকে এপর্যন্ত ১৪৭০৭ জন লোক উপকৃত হয়েছেন। এছাড়াও ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে প্রথম বারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নিমিত্তে অর্থ প্রেরণ করা হয়।

ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি রোধের জন্য প্রাথমিকভাবে সিটি করপোরেশন শহরের কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেছে। এলাকাগুলো হচ্ছে—বিমান বন্দরে প্রবেশ পথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা,  বিমান বন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশের এলাকা, হোটেল রেডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল রূপসী বাংলা সংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরণী এবং কূটনৈতিক জোনগুলো।

ঢাকার ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাগুলো ভিক্ষুকমুক্ত রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত মাইকিং, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ এবং বিভিন্ন স্থানে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড মেরামত/নতুন স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে বলে সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। 

এছাড়াও ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আটক ভিক্ষুকদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার নিমিত্তে ৫টি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৬টি টিনশেড ডরমিটরি ভবন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে বলে জানায় সমাজসেবা মন্ত্রণালয় সূত্র।