সুন্দরবন রক্ষায় অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিলের দাবি

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারত থেকে নিম্নমানের কয়লা আনা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে কোল ইয়ার্ডের জন্য এই কয়লা আনা হচ্ছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নয়। কিন্তু নিম্নমানের এই কয়লা আসবে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নদী দিয়েই। আর তাতে দূষণের শঙ্কায় পড়তে যাচ্ছে সুন্দরবনের নদী, প্রাণ-প্রকৃতি। এই অবস্থায় কোনওভাবেই সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে কয়লা আনা যাবে না এবং অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করতে হবে বলে দাবি করেছেন সমাজের বিশিষ্ট জনেরা।

আজ সোমবার (৫ জুলাই) বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির যৌথ উদ্যোগে “রামপালমুখী ভারতীয় কয়লা, বিপদাপন্ন সুন্দরবন ও ইউনেস্কো বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভা” শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি সুলতানা কামাল।

সম্মেলনে বাপা’র সহ-সভাপতি রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, আমরা উন্নয়ন বিরোধী নই। যে কেন্দ্র এক সময় বন্ধ করতেই হবেই সেই কেন্দ্রের পেছনে কেন টাকা খরচ করা হবে। সাধারণ মানুষও বোঝে রামপালের কারণে নদীর ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার অনীহাও এই ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে সবাইকে নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বাপা’র নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, রামপাল এলাকার মানুষ ছাড়া বাইরে সবাই বুঝতে পারেন এটা কি ক্ষতি হতে পারে। স্থানীয় আন্দোলনকারীরা অনেক বিপদে আছে। তাদের পাশে সারা দেশের মানুষকে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই। আন্দোলন ধরে রাখতে হবে। সারাদেশে ছড়াতে হবে এই আন্দোলন। না হলে এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে পারবো না। কিছু সংগঠনের দাবিতে এই রামপাল বন্ধ হবে না। একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল তার উপস্থাপনায় বলেন, আমরা এত প্রতিবাদ করার পরও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। ইউনেস্কোর কথাও শুনছে না সরকার। ইউনেস্কোর জন্য সুন্দরবন বিষয়ে সিইজিআইএসের (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিসেস) মাধ্যমে যে প্রতিবেদন করা হবে তার কতখানি নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ সেখানে সরকারি লোকই আছে। শুধু রামপাল নয়, তালতলী ও কলাপাড়ায় যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে তাও সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ হতে পারে কিনা তাও ইউনেস্কোর দেখা উচিত। রামপাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কোল ইয়ার্ডের ফ্লোর করার জন্য কয়লা আনা হচ্ছে। আসলে ইয়ার্ড করতে কত কয়লা লাগতে পারে সে বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তিনি বলেন, সরকার মুখে বলছে তারা সুন্দরবনের ক্ষতি হোক তা চায় না। কিন্তু শুধু মুখে বললেই হবে না কাজের ক্ষেত্রেও এই জিনিস দেখাতে হবে। আমরা অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের দাবি জানাই এবং একই সাথে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে যেকোনও ধরনের কয়লা নিয়ে আসার বিরোধিতা করি।

অধ্যাপক এম. এম. আকাশ বলেন, রামপালের ক্ষেত্রে সরকার কোনও যুক্তিতর্কই মানছে না। অনেক কেন্দ্র বাতিল করেছে। এটা কেনো করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এইগুলা আসলে তো আরও বিদ্যুৎ আমরা পাবো। এক সময় না এক সময় এই কয়লা কেন্দ্র বন্ধ করতেই হবে। তাহলে যে কেন্দ্র বন্ধ করতেই হবে এই কেন্দ্র কেনো এখন করতেই হবে। এটা এখনই বাদ দেয়া উচিত।

ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ড. রনজিত শাহু বলেন, এটি অনুমোদন দেয়াই বড় ভুল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের আরও অনেক জ্বালানি আছে। কয়লায় যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলেন, এই কয়লা পোড়ালে বায়ু দূষণ হবেই। যতই ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেনো। এই কেন্দ্রের ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) এ বলা হয়েছিল রামপালে কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে। কোথাও ভারতীয় কয়লার কথা লিখা ছিল না। ভারতের কয়লার মান খুবই খারাপ। ভারতের ধানবাদ থেকে যে কয়লা আসবে তাতে এত নিম্নমানের খনিজ মেশানো থাকে যে এটা পোড়ালেই দূষণ হবেই৷ বায়ু ও পানি দূষণ তো হবেই। তিনি বলেন, কয়লা পরিবহনের সময় যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে নদীর দূষণ তো হবেই। সরকার বলছে, এই কয়লা পোড়ানো হবে না। কোল ইয়ার্ড ৪৫০০ টন কয়লা লাগবে। তারা বলেনি এটাই শেষ। তারা এমনভাবে বলছে তাতে মনে হচ্ছে প্রথমে ৪৫০০ টন কয়লা আসছে। এদিকে ভারতের পত্রিকাগুলো বলছে ২০ হাজার টন কয়লা লাগবে। এটাও চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, ক্লিন কোল বলে আসলে কিছু নেই। কয়লা পোড়ালে দূষণ হবেই। কাজেই এটি একটি বড় মিথ্যা।

নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী মানবাধিকার কর্মী, খুশী কবির বলেন, অনেকেই বলেন যারা প্রতিবাদ করছেন তারা সঠিক তথ্য জানে না। তাহলে সঠিক তথ্য কি? নদী দিয়ে যে কয়লা আনা-নেওয়া করবে তাতে নদীর দূষণ হবে না এই নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে যে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তারাও কি কিছু জানে না। সরকার তথ্যগুলো সঠিকভাবে দিচ্ছে না। আমরা তথ্য চাইলে দেখছি যে একেকবার একেক রকম তথ্য দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এমন কয়লা আনা হচ্ছে যে কয়লা ভারতের কেন্দ্রেও ব্যবহার করা হয় না। এই ক্ষতি হবে অপূরণীয়। আরও বেশি প্রকৃতিকে বিনষ্ট করবে। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কয়লা বন্ধ করতেই হবে কয়েক বছরের মধ্যে। এটা আনার কোনও যুক্তি নেই। অস্বচ্ছতার কারণ হতে পারে‑ কারো স্বার্থ দেখা হচ্ছে। দেশের স্বার্থ না।

বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা বলছি, সরকার শুনছে না। উনারা না শুনলেও এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ইআইএ-টা এখন আর আগের মতো নেই। সম্প্রতি সরকার বলেছে, ইআইএ দেরি হলে কাজ শুরু করে দিতে। তাহলে ইআইএ-র মূল্য কই থাকলো। সরকার জনমত উপেক্ষা করেই এসব করে যাচ্ছে। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন দরকার। যেখানে আমাদের এখনই ওভার ক্যাপাসিটি হয়ে গেছি। বাড়তি বসে থাকা এই এ কেন্দ্রের জন্য আমাদেরই টাকা ট্যাক্স থেকে কেটে নেয়া হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল আসলে করা হবে না। এটার এই অবস্থায় কোনও বাস্তবতা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে। যা এক সময় আর কোনও কাজে লাগবে না। যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেগুলো আসলেই তো বাড়তি হয়ে যাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ বাড়ান। বাংলাদেশ চাইলেই পারে। এতে বাংলাদেশ প্রশংসিত হবে। আবার ততটাই নিন্দিত হবে বাংলা যদি এই ওভার ক্যাপাসিটি পর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়।

খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, এই কারণে ইউনেস্কো যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেয় সেটা পুরো দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। আর সরকার যেসব কথা বলছে তার কোনটিই বাস্তবে পালন করা হয় না। ধন্যবাদ জানাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করেছে বলে। কিন্তু কেনো বাদ দিলো তা স্পষ্ট নয়। দশটার সাথে মাতারবাড়ি,  রামপাল প্রকল্প বাতিল করেন। এসব প্রকল্পে বন্ধুত্বের কথা বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের ক্ষতি হলে এই বন্ধুত্ব নষ্ট হবে। সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে, এই আন্দোলন চলবে।