‘কয়লাভিত্তিক প্রকল্প হলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত হবে’

কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম দূষণকারী দেশ হিসেবে রূপান্তরিত হবে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার বন্ধসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার এবং প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে আসন্ন কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) টিআইবি আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।

সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানি বৈশ্বিক মোট কার্বনের তিন-চতুর্থাংশ নিঃসরণ করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ইউরোপের ৫০টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট-জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সংশোধিত আইএনডিসি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তারা ভারী শিল্পগুলো যেমন- পরিবহন, ইস্পাত ও ভারী শিল্প খাত থেকে অপর্যাপ্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা দিয়েছে। তাদের দেওয়া সংশোধিত প্রতিশ্রুতি কার্বন হ্রাসে বৈশ্বিক মোট ঘাটতির মাত্র ২০ শতাংশ পুষিয়ে দিতে পারবে। সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলো দ্রুত সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাসের সরাসরি বিরোধিতা করছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সংশোধিত আইএনডিসি জমা দিলেও সেখানে কার্বন হ্রাসের বাড়তি কোনও কার্যক্রম ও পরিকল্পনা দেয়নি। প্রস্তাবিত ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন কয়লা প্রকল্প গ্রহণ বন্ধের ঘোষণা সরকার দেয়নি। রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালী প্রকল্পসহ মোট ১৯টি কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬৩ গুণ বাড়বে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করবে। ফলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম কয়লা দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানায়, প্রাক-শিল্পায়ন সময় থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ১৯৬টি দেশ প্যারিস চুক্তিতে সম্মত হয়। কিন্তু প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রদত্ত অঙ্গীকার প্রতিপালনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির পর ছয় বছর অতিবাহিত হলেও দেশগুলো চুক্তি বাস্তবায়নের পথরেখা চূড়ান্ত করতে পারেনি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এরই মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি হ্রাসে সবচেয়ে বড় বাধা কার্বন নিঃসরণকারী কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার, রফতানি এবং এ খাতে বিশ্বব্যাপী অর্থায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিশ্রুত উন্নয়ন সহায়তার অতিরিক্ত নতুন ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট-জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, কয়লার ব্যবহার বন্ধ, প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন, বর্ধিত স্বচ্ছতা কাঠামো ও প্যারিস রুলবুক চূড়ান্ত করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এ বছর কপ-২৬ এ আলোচনা হবে। যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ জলবায়ু সম্মেলনকে প্যারিস চুক্তি পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত এবং সমঝোতায় পৌঁছানোর শেষ সুযোগ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্যারিস চুক্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানোর কথা থাকলেও বাস্তবচিত্র উল্টো। উন্নত দেশগুলো ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার ১১০ ভাগ বাড়ানোর পরিকল্পনা, কয়লার উৎপাদন ২৪০ ভাগ, তেল ৫৭ ভাগ আর গ্যাস ৭১ ভাগ বাড়ানোর পরিকল্পনা, জি-২০ দেশগুলোর ৩০০ বিলিয়ন ডলারের নতুন তহবিল জীবাশ্ম খাতে অর্থায়ন করার পরিকল্পনা, রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালীসহ বাংলাদেশে মোট ১৯টি বড় কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত, প্রকল্পগুলোর একটি বড় অংশ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় জেলায় নির্মাণ, প্যারিস চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে জাপান, চীন ও কোরিয়াসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রদানে উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি। এসব বন্ধে ১৪টি সুপারিশও করে সংস্থাটি।

এ সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, উপদেষ্টা পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।