দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলার বদলে জরিমানায় আগ্রহী পরিবেশ অধিদফতর: টিআইবি

দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করার বদলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে জরিমানা নির্ধারণে পরিবেশ অধিদফতর বেশি আগ্রহী বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

বুধবার (৫ জানুয়ারি) ‘পরিবেশ অধিদফতরে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করে টিআইবি।

পরিবেশ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের ব্যর্থতা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের অনিয়মসহ সুশাসনের সকল সূচকে ঘাটতির কারণে পরিবেশ অধিদফতরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে বলেও মনে করছে টিআইবি। এর ফলে পরিবেশ অধিদফতর দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনেকাংশে অক্ষম ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করে সংস্থাটি। একই সঙ্গে সংকট উত্তরণে দশ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে সংস্থাটি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় দেখা গেছে, আমলানির্ভরতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিরীক্ষায় ঘাটতি, পেশাগত দক্ষতার অভাবসহ পরিবেশ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগেও ব্যর্থ হয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অংকের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির ফলে পরিবেশ অধিদফতরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। অধিদফতরের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাংশের যোগসাজশ এবং তাদের প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে অধিদফতরের কার্যকরতা ব্যাহত হচ্ছে। অধিদফতরের কার্যক্রমে সুশাসনের বিভিন্ন নির্দেশক যেমন—স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, জনসম্পৃক্ততা এবং কার্যকর সমন্বয়ে ঘাটতি বিদ্যমান। একদিকে সামর্থ্যের ঘাটতি এবং অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে ঘাটতিই ব্যর্থতার মূল কারণ। এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সরকারি বিভিন্ন বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার কার্যক্রমের অংশ হওয়ার কথা থাকলেও পরিবেশ অধিদফতরের বিদ্যমান ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থতা লক্ষণীয়।

টিআইবি জানায়, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিশ্র পদ্ধতিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। ৩০টি মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং প্রধান ও মাঠ পর্যায়ের ৭টি কার্যালয় পর্যবেক্ষণ এবং ৩ শত ৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপের মাধ্যমে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করে আইনের শাসন, সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, অংশগ্রহণ, কার্যসম্পাদন, সমন্বয় ও অনিয়ম-দুর্নীতি-এ আটটি সূচকের আলোকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, জরিপকৃত শিল্প কারখানার শতকরা ৫১ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যার শতকরা ৭০ ভাগ তথ্য সংগ্রহের সময় পর্যন্ত নবায়নের জন্য আবেদনই করেনি। অন্যদিকে, দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনও তালিকা না থাকায় ‘দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান’ মানদণ্ডের আলোকে জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণে ঘাটতি রয়েছে। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করার পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে জরিমানা নির্ধারণে অধিদফতর বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা মামলার বাইরেও ফৌজদারি আইনের মামলার বোঝা রয়েছে পরিবেশ আদালতের ওপরে।

সার্বিক বিবেচনায় পরিবেশ অধিদফতরে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে দশ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো—আইনের যথার্থ প্রয়োগে ভয়, চাপ ও আর্থিক প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানাগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা; প্রেষণে পদায়ন না করে অধিদফতরের নেতৃত্বে বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া; যথাযথ চাহিদা নিরূপণসাপেক্ষে সকল কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, কারিগরি ও লজিস্টিক্যাল সুবিধা নিশ্চিত করা; প্রকল্প বাস্তবায়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত সকল কর্মীর বাৎসরিক আয় ও সম্পদের বিবরণী বছর শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়াসহ তা প্রকাশ করা ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন—টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন—টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিষয়ক রিসার্চ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা। এই গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেছেন একই বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্‌জুর-ই-আলম।