বায়ুদূষণে বিপজ্জনক শহর এখন ঢাকা

আজ বুধবার (২৫ জানুয়ারি) সকাল ১১ থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। বায়ুদূষণ স্কোরে ঢাকার এই অবস্থানকে বলা হয় বিপজ্জনক বা দুর্যোগপূর্ণ। গত সোমবার এবং রবিবারও শীর্ষ অবস্থানে ছিল ঢাকা। এক সপ্তাহের মধ্যে বায়ুদূষণে তিনবার ঢাকার অবস্থান শীর্ষে উঠে এসেছে। এভাবে গত কয়েক সপ্তাহে বায়ুদূষণে ঢাকা সবার ওপরের দিকে উঠে আসছে। পরিস্থিতি বলছে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে।

ঢাকার চারপাশে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ হলেও এখনও অনেক ইটভাটা রয়েছে, যারা কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করছে। আবার রাজধানীতে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এসব গাড়ির কালো ধোঁয়াও পরিবেশকে দূষিত করছে। কিন্তু ঢাকার বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কেবল রাস্তায় পানি ছিটানো ছাড়া আর কোনও কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না।

আজ ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেলা ৪টায় ছিল ২৪৩, আর বেলা ১২টায় ছিল ২২৮। সোমবার ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ ছিল ৩৩৩। রবিবার (২২ জানুয়ারি) মাত্রা ছিল ২৭১।

বায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে মাত্রা থাকলে তা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে চিহ্নিত করা হয়। শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই মাত্রাকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১-এর বেশি স্কোরকে ‘বিপজ্জনক’ বা দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিটি করপোরেশন যে পানি ছিটাচ্ছে তাতে বড় রাস্তার ধুলাবালি কিছুটা কমবে। এখন যে অবস্থা তাতে ঢাকা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার অবস্থা আর নেই।  মানে যে পরিমাণ দূষণ এখন হচ্ছে তা রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়। একমাত্র বৃষ্টি হলেই এই মাত্রা কমে আসতে পারে। উপায় একটা আছে, ঢাকার রাস্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করতে হবে, নির্মাণবিধি না মেনে যেখানে-সেখানে যেসব রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে ঢাকার কয়েকশ’ কিলোমিটার এলাকার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় আছে। খোঁড়া রাস্তায় আবার গাড়ি চলছে, তাতে আবার যানজট হচ্ছে, যানজটের ফলেও বায়ুদূষণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, সরকার প্রচুর অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধ করেছে। এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অবৈধ গাড়ি তো বন্ধ করা যাচ্ছে না। দূষণের কারণগুলো আমরা প্রায় সবাই জানি। শুধু পানি ছিটিয়ে নয়, সব দূষণের কারণের প্রতিকার করতে হবে। না হলে দূষণ কমানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশন রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ধুলা কমানোর চেষ্টা করছে। যদিও মাত্র দুইটা মেশিন দিয়ে তারা চেষ্টা করছে। এদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তো কোনও পদক্ষেপই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

বায়ুদূষণ কমাতে ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। প্রতিদিন দুটি স্প্রে ক্যানন ডিএনসিসি এলাকার মহাসড়কে পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শুধু পানি ছিটিয়ে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বায়ুদূষণ এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দূষণের মাত্রা কী পরিমাণ বেড়ে গেছে, আমাদের ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ কেনার হিড়িক দেখেই বোঝা যায়। বাড়ছে কিডনি, ফুসফুসের অসুখ। শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, অর্থনৈতিক জায়গাও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা এমন দূষিত শহরে বিনিয়োগ করতে নাও চাইতে পারেন। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আমাদের উন্নয়নকাজও। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যেখানে স্বল্পমেয়াদি,  মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়াও জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, পানি ছিটিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য হয়তো দূষণ কমবে কিন্তু এটা তো সমাধান না। দূষণ নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনও উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ছে না। দিন দিন মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে যানবাহন। 

ঢাকায় যেসব গাড়ি চলছে তাদের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও কিছুটা দূষণের মাত্রা কমে আসতে পারে। তিনি বলেন, দেশের ভেতরে যেমন আমাদের দূষণের অনেক কারণ আছে, তেমনি পার্শ্ববর্তী দেশের দূষণও আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের নিজেদের দূষণ বাড়ছে, আবার বাইরে থেকে দূষণ ঢুকছে। তিনি বলেন, সরকার বা সংশ্লিষ্টদের উচিত একটা টাইমফ্রেম দিয়ে একেকটা নির্দিষ্ট এলাকা টার্গেট করে দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নির্মাণ, যানবাহন,  শিল্পকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই দূষণ কমে আসবে। আর বাইরের দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।