প্রতিবছর একাধিকবার পশুর নদে কয়লা, সিমেন্ট ও তেলবাহিত কার্গো ডুবির খবর আসে। এসব নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়, বিপন্ন হয় জলজ প্রাণী। ডুবে যাওয়ার পর কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা অনিয়ম সামনে আসে। কারোর ক্ষেত্রে দেখা যায়— ফিটনেস নেই, লাইসেন্স নেই, এমনকি মাস্টারের কাগজেরও মেয়াদ নেই। কোনও একটি দুর্ঘটনায় পরিবেশ, নৌপরিবহন ও বনবিভাগ সবাই খুব কাছাকাছি দায়িত্বের মধ্যে থাকলেও সমন্বয়হীনতায় দুর্ঘটনা থামছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পরিবেশবাদী ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০ বছরে একের পর এক কয়লা ও তেলবাহী জাহাজডুবিতে শত শত টন কয়লা পানিতে মিশেছে। এর ক্ষতির দিকটি হয়তো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু বন ও নদীর প্রাণপ্রকৃতি এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদের জন্য এর ফল ভালো হবে না।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর পশুর নদের চরকানা এলাকায় ৮শ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় ‘এমভি প্রিন্স অব ঘষিয়াখালী’ নামে একটি কার্গো জাহাজ। ঘটনার পরপরই কয়লা উত্তোলনে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হলেও কাজ শেষে জাহাজ মালিক মো. বশির হোসেন গণমাধ্যমকে জানান— তার ৩০০ টন কয়লা পানিতে মিশে গেছে। মিশে যাওয়া কয়লায় যে ক্ষতি হয়, তার দায় কার? এর ঠিক একমাস আগে আটশ’ মেট্রিক টন সিমেন্ট ক্লিংকার নিয়ে মোংলা বন্দরের পশুর নদে ডুবে যায় আরেকট কার্গো জাহাজ এমভি আনমনা-০২। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততার সঙ্গে জাহাজ উদ্ধারের কাজ সম্পন্ন না করায় প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।
কয়লা থেকে দূষণের শঙ্কার বিষয়ে বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আরেফিন বাদল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়লার মধ্যে আর্সেনিক, সালফারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থাকে। দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকলে এই কয়লা পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করতে পারে। পানি দূষিত হলে পশুর নদের মাছসহ নানা ধরনের প্রাণিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখার উপপরিচালক সৈয়দ আহম্মদ কবীর বলেন, ‘কেবল তেল ডুবলে তারা বিষয়টি ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা করতে পারেন। বাকি ঘটনায় মন্ত্রনালয় থেকে কমিটির মাধ্যমে হয়।’
জরিমানার পরিমাণ কী রকম হয় প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন জরিমানা নির্ধারণ নেই। তেল কতটা বিস্তৃত হয়েছে, সেই অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়।’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনা হলেই দেখা যায়, কার্গোর কাগজ হালনাগাদ নেই। যে কার্গোই ডুবে, তার লাইসেন্স নেই, রেজিস্ট্রেশন নেই, ড্রাইভার- মাস্টারদের কাগজ নেই। এসব মনিটরিং বা চেকিংয়ে বনবিভাগের কোনও সংশ্লিষ্টটা নেই। আমরা লঞ্চ মনিটর করি। এখানকার সব লঞ্চের সব কাগজ হালনাগাদ রয়েছে। এ কাজে আমাদের মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা দরকার।
কার্গো ডুবলে কাগজপত্র হালনাগাদ পাওয়া যায় না কেন, এ বিষয়ে কথা বলতে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (বোর্ড) কালা চাঁদ সিংহের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা কও তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, একই এলাকায় ২০২২ সালের ৬০০ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় এমভি নওমী নামের আরও একটি কার্গো জাহাজ। ২০২১ সালের ৭০০ টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি বিবি-১১৪৮’ ডুবে যায় পশুর নদের বানিশান্তা এলাকায়। ওই বছরেই ৫০০ টন কয়লা নিয়ে ক্রিক বয়ায় ডুবে যায় ‘ইফসিয়া মাহী’ কার্গো জাহাজ এবং ড্যাপ সার নিয়ে ডুবে যায় ‘এমভি দেশবন্ধু’ নামে কার্গো জাহাজ। ‘এমভি ফারদিন-১’ ডুবে ৬০০ টন কয়লা নিয়ে। তারও আগে ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৭৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় ‘এমভি বিলাস’ কার্গো। আর ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ৭০০ টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি আইজগাতি’ কার্গো ডুবে পশুর নদের মোংলা বন্দরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকায়।
আরও পড়ুন:
কয়লা নিয়ে পশুর নদে আবারও ডুবলো কার্গো জাহাজ
বারবার কয়লা-সারবাহী নৌযানডুবি, হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য