অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন টেলিভিশন টকশোতে আলোচিত মুখ মোহাম্মদ এ আরাফাত। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে জয় পেতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছেন তিনি।
মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, এখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো তিনটা। এক. আমরা বিজয়ী হতে চাই, সে জন্য সব চেষ্টাই আমরা করছি। দুই. ভালো সংখ্যক ভোটারদের মোটিভেট করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা। একটা ভালো সংখ্যক ভোটার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হতে চাই। তিন. একটি সুন্দর ও স্বচ্ছ নির্বাচন—যেটা নিয়ে কোনও ধরনের বিতর্কের সুযোগ যেন না থাকে। এই তিনটা ফ্রন্টেই আমরা বিজয়ী হতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আপনার প্রস্তুতি কেমন? সেই সঙ্গে আপনার নির্বাচনি পরিকল্পনার বিষয়ে যদি আমাদের বলতেন…
মোহাম্মদ এ আরাফাত: আওয়ামী লীগের নির্বাচনের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। বিশেষ করে নির্বাচনি পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেছি। এখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে এসেছি।
একটা মজার বিষয় হলো—কার জনসমর্থন বেশি আছে, তার ওপর কিন্তু নির্বাচনের বিজয় নির্ভর করে না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিজয়টা নির্ভর করে একটা মার্কা ও একজন প্রার্থীকে সমর্থনকারী ভোটারদের মধ্যে কত জন ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিচ্ছে, তার ওপর। কাজেই ভোটারদের মোটিভেট করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা, ভোটের জন্য কেন্দ্রে আসতে হয়, লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হয়—অনেকেই মনে করে, এটা একটা ঝামেলা। তার জন্য মোটিভেশন দরকার। ভোটারদের মোটিভেট করা একটা চ্যালেঞ্জের কাজ। এই কাজটা করতে একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার, একটা রাজনৈতিক সংগঠন দরকার।
আমার নির্বাচনি এলাকায় ১২৪টি ভোটকেন্দ্র আছে। প্রতিটি কেন্দ্র নিয়ে কমিটি করতে হচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা থাকবেন। অনেক স্থাপনা আছে, সেগুলোর ভিত্তিতে কমিটি হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি করা হবে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করতে হবে। অনেক লোককে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই সংখ্যাটা অনেক বড়। এই মানুষগুলো ভোট দিলে অনেক ভোট। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ভোট দিলেই ২০-৩০ হাজার ভোট পড়বে। সাধারণ ভোটারদের মোটিভেট করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা, তাদের আসা-যাওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করা, তাদের কাছে ভোটার নম্বরের স্লিপ পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা বুঝতে পারে কোন কেন্দ্রে ভোট দেবেন তারা; এটা করতে যে কর্মী বাহিনী লাগে, সেটা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে বিজয় সুনিশ্চিত করে।
সে কারণে অনেকে মনে করেন, আমি যতই গণমাধ্যমে বা যেকোনোভাবে পরিচিত মুখ হই, সেলিব্রিটি হলে অনেকে ভাবে— আমাকে তো অনেকেই পছন্দ করে। আমি কোথাও গেলে অনেকেই আসে দেখা করতে, পেছনে হাঁটে। আমি বোধহয় জনপ্রিয় মুখ, আমি নির্বাচনে জিতবো। কিন্তু জনপ্রিয় হলেই নির্বাচনে জেতা যায় না। নির্বাচনকেন্দ্রিক যে ব্যবস্থাপনা, যে প্ল্যাটফর্ম লাগে এটাই সবচেয়ে বড় জায়গা। এ বিষয়টা এর আগেও জানতাম, এখন আরও বিশেষভাবে বোঝাপড়া হলো।
মোহাম্মদ এ আরাফাত: অবশ্যই এটা একটা চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু অল্প কিছু দিনের জন্য এই উপনির্বাচন, স্বাভাবিকভাবেই ভোটারদের আগ্রহ কম থাকবে। এখানে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং এর সঙ্গে অন্য উগ্রবাদী যে দলগুলো থাকে, তারা নির্বাচনের মাঠে নেই। তারা নির্বাচনের মাঠে না থাকলেও বিভিন্নভাবে, অদৃশ্যভাবে আছে। তারা সক্রিয় আছে। তাদের দুইটা উদ্দেশ্য—আমাদের যেকোনোভাবে নির্বাচনে পরাজিত করা, ভোটারদের নিবৃত্ত করা। যাতে দেখানো যায় যে নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কম। তাই এখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো তিনটা— এক. আমরা বিজয়ী হতে চাই, সে জন্য সব চেষ্টাই আমরা করছি। দুই. ভালো সংখ্যক ভোটারদের মোটিভেট করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা। একটা ভালো সংখ্যক ভোটার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হতে চাই। তিন. একটি সুন্দর ও স্বচ্ছ নির্বাচন, যেটা নিয়ে কোনও বিতর্কের সুযোগ যেন না থাকে। এই তিনটা ফ্রন্টেই আমরা বিজয়ী হতে চাই।
প্রধান প্রতিপক্ষ নির্বাচনে না থাকলে দলের ভেতরও অনেকে দুর্বল হয়ে যায়, যেহেতু অল্প সময়ের নির্বাচন। তবে আমি বলতে চাই, এবার আমাদের দল চাঙা। কিছু দিন আগে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসেছিলাম। ঢাকা-১৭ আসনের ওয়ার্ডভিত্তিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও বসেছি। সবাইকে এনার্জিটাইজ করতে পেরেছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটাই সবশেষ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। যদিও অল্প সময়ের, তারপরও এটা জাতীয় একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। সারা বিশ্বকে দেখাতে চাই—আওয়ামী লীগ শুধু বিজয়ী হয় না, যথেষ্ট ভোটার উপস্থিতি এবং স্বচ্ছ ও বিতর্কহীন নির্বাচন করা যায়। যেহেতু এই আসন এলাকায় কূটনৈতিক জোন, আর এই নির্বাচনে গোটা বাংলাদেশের আগ্রহ আছে, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। সব মিলিয়ে এই নির্বাচনের একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: টেলিভিশন টকশোসহ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আপনি আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে যেসব বিষয় বলতেন, এখন ভোটের মাঠে সেগুলো প্রমাণ করতে পারবেন কিনা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির পর বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
বাংলা ট্রিবিউন: এই উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন বেশ কয়েকজন। কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: বিএনপি নির্বাচনে না এলেও জাতীয় পার্টিসহ ছোট ছোট দলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। তবে অন্যান্য নির্বাচনের মতো এখানেও বিএনপি কারও না কারও কাঁধে ভর করবে, কিছু না কিছু সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করবে। ফলে তাদের কিছু অপচেষ্টা থাকবে, সেটি নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি ফোকাস করছি নৌকা। আমাদের কর্মী বাহিনীকে চাঙা করছি। এই আসনে যে পরিমাণ আওয়ামী লীগের কর্মী আছেন, তার ১০ ভাগের একভাগও ভোটার নেই। এখন আমাদের কাজ হলো, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করে ভোটারদের ভোট দিতে কেন্দ্রে নিয়ে আসা। যাতে পরবর্তী সময়ে এটা আমরা কাজে লাগাতে পারি।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা-১৭ আসনে গুলশান-বনানীর অভিজাত ভোটারের পাশাপাশি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার রয়েছে। এই উপনির্বাচনে ভোটার টানা কঠিন হবে কিনা? এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: এই আসনে যতটা অভিজাত ভোটার রয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও বস্তির ভোটার। মূলত তারাই বেশি ভোট দেয়। দিন শেষে এটি অভিজাত এলাকা বটে, কিন্তু যিনি নির্বাচিত হন—তিনি মেজরিটি ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন। এটা ডিপ্লোমেটিক জোন হওয়ায় আসনটির আলাদা গুরুত্ব আছে। কিন্তু আমার লক্ষ্য থাকবে পুরো আসনকে নিয়ে, অভিজাতদের নিয়ে আলাদা কোনও ফোকাস থাকবে না।
বাংলা ট্রিবিউন: অল্প সময়ের এই উপনির্বাচনে জয়ী হলে আপনি কোন কাজগুলো অগ্রাধিকার দেবেন? আপনার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পাবে কোন বিষয়গুলো?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: ঈদুল আজহার পর আমরা নির্বাচনি ইশতেহার দেবো। আমাদের লিফলেটে প্রতিশ্রুতিগুলোর অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকবে। ভাসানটেক, মানিকদি, মাটিকাটা, কড়াইল, সাত তলা বস্তিসহ বিভিন্ন স্থানে লোক পাঠানো হয়েছে, তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে। সেই সঙ্গে গুলশান-বনানী-বারিধারার মানুষের চাওয়াগুলোও জানতে লোক পাঠানো হয়েছে। এই আসনে কী কী কাজ এখনও বাকি রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। যদিও অল্প সময়ের জন্য কাজের সুযোগ, তারপরও যতটুকু করা যায় করবো। এই আসনে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন না, সবশেষ ফারুক পাঠান ভাই আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ থাকায় সেভাবে কাজ করতে পারেননি। সেই শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: ভোটারদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হিরো আলমও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে আপনি তাকে কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: এই আসনে আমিসহ মোট ৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। তাদের কারও ব্যাপারে আমি আলাদা করে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। আমার বক্তব্য সিম্পল— দেশের যেকোনও নাগরিকের সংবিধান অনুযায়ী, আইনের মধ্যে থেকে নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। যারা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন, তাদের আমি শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের প্রতিপক্ষ (বিএনপি) যারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে যারা নির্বাচন করতে এসেছেন, তাদের ওয়েলকাম জানাই। এটা ভালো। তবে আলাদাভাবে কোনও প্রার্থী বা দলকে নিয়ে বক্তব্য দিতে চাই না। কারণ, আমার ফোকাস শুধু নৌকায়। আমি নৌকা নিয়ে ফোকাস করছি, এলাকা নিয়ে ফোকাস করছি। এর বাইরে কোনও কিছু ফোকাস করছি না। সুতরাং, যেটা নিয়ে ভাবিই না, সেটা নিয়ে কী মন্তব্য করবো!
প্রসঙ্গত, সোমবার (২৬ জুন) ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন। আসনটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। আর একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী আলোচিত ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম ‘একতারা’ প্রতীক পেয়েছেন।
এছাড়া এই আসনে প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন জাতীয় পার্টির সিকদার আনিসুর রহমান (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. রেজাউল ইসলাম স্বপন (ডাব), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. আকতার হোসেন (ছড়ি), জাকের পার্টির কাজী মো. রাশিদুল হাসান (গোলাপ ফুল) ও তৃণমূল বিএনপির শেখ হাবিবুর রহমান (সোনালী আঁশ)।
কয়েক মাসের জন্য আইন প্রণেতা নির্বাচনের এই ভোটে দলীয় প্রার্থীরা প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন। আগামী ১৭ জুলাই ব্যালট পেপারের মাধ্যমে এই আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।