মায়ের জন্য কাঁদে প্রবাসীর মন

গত ১০ বছর প্রবাসে আছেন রিপন আহমেদ। এখন থাকেন বাহরাইনে। এপ্রিলে করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসিউতে ছিলেন সাত দিন। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি। এ সময়টা পরিবারকে খুব মিস করছেন রিপন, বিশেষ করে মাকে। তিনি বলেন, ১০ বছর একটি ঈদও করতে পারিনি মায়ের সঙ্গে।

মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন রিপন। বললেন, ‘মায়ের জন্য ও আমার বাচ্চাদের জন্য খারাপ লাগে। করোনা পরিস্থিতিতে হুটহাট ফ্লাইট বন্ধ হচ্ছে। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার ইচ্ছে আছে। জানি না যেতে পারবো কি না।’

শুধু রিপন আহমেদই নন, প্রবাসী কর্মীরা সব সময়ই পরিবার থেকে দূরে থাকায় বিষণ্ন সময় কাটান। অনেকেই দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে পারছেন না নানা কারণে। মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে ফেরার আকুতিও জানাতে পারেন না কারও কাছে। আর এ কষ্ট যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চলমান মহামারি। ২০২০ সাল থেকে দেশে দেশে লকডাউন, ফ্লাইটও বন্ধ। টিকিট কেটেও দেশে ফেরা হয়নি অনেকের।

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালন করা হয় বিশ্ব মা দিবস। এ দিবসকে কেন্দ্র করে মাকে নিয়ে নিজের অনুভূতির কথা জানান প্রবাসী কর্মীরা। মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার কষ্টে থাকলেও কেউ জানালেন, পরিশ্রম করে মায়ের হাতে, পরিবারের হাতে টাকা তুলে দিতে পারার আনন্দটাও কম নয়।

মালয়েশিয়ায় আছেন রাজন। মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয় ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বরে। সেবার সরাসরি এসেছিলেন দেশে। এখন টেলিফোনে কথা বলাই্ সান্ত্বনা। রাজন বলেন, ‘চাইলেই তো দেশে আসতে পারবো না। ফোনে কথা বলি। কোনও কোনও দিন দুই ঘণ্টাতেও কথা শেষ হয় না। মা দেশে আসতে বলে ঈদে। কিন্তু কী করবো। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি। অভাব-অনটন লেগে আছেই। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তারওপর এর মাঝে দেশে গেলে মহামারির কারণে আটকা পড়ে যেতে পারি।’

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ১৪ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ছিল। তবে প্রবাসী কর্মীদের কথা বিবেচনা করে ১৭ এপ্রিল থেকে পাঁচটি দেশে ফ্লাইট চালু হয়। পরে আরও কয়েকটি দেশে ফ্লাইট শুরু হয়। ১ মে থেকে নতুন শর্ত সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক কমারশিয়াল ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

তবে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে ৩৮টি দেশে যাওয়া-আসার ওপর শর্ত আরোপ করেছে বেবিচক। যার মধ্যে ১২টি দেশ থেকে এখন ফিরতে পারবেন না প্রবাসীরা।

নূর নবী থাকেন বাহরাইনে। আক্ষেপ নিয়ে জানালেন, ‘২২টি ঈদ করা হয়নি পরিবারের সঙ্গে। মা-বাবা দুজনেই দেশে আছেন, ভালো আছেন। আমার দুঃখ নেই। কারণ আমার কারণে পরিবারগুলো নিশ্চিন্তে সব কেনাকাটা করতে পারছে। এতেই আমি খুশি।’

এবার ঈদে মা-বাবা ও পরিবারের জন্য ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন নূর নবী। তিনি বলেন, ‘ফোন দিলে, মা বলে- বাবা বুক খালি করে কোথায় চলে গেলি। টাকা পাঠাস, কিন্তু মা কিভাবে ঈদ করি! তোর টাকায় কাপড় কিনি, সেটা তো তুই দেখতে পারিস না বাবা। মা সব সময় কান্নাকাটি করে। কী করবো। গরীব হয়ে জন্ম নিলে যা হয়!’

সাউথ আফ্রিকা থেকে ছুটিতে এসেছিলেন আবুল হোসেন লিটন। আবার সাউথ আফ্রিকা ফিরে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে মা-কে হারান। মৃত্যুর সময় মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়নি তার।

ওমানে আছেন তৈয়ব সিদ্দিকি। দেশে আসার জন্য টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় ফেরা হলো না। বাংলা ট্রিবিউনকে তৈয়ব বললেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে টিকিট কনফার্ম করেছিলাম মা, স্ত্রী-সন্তান ও ভাই-বোনের সঙ্গে ঈদ করবো বলে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। ওমানের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেলো। আমাদের প্রবাসীদের স্বপ্ন দেখতে নেই। কারণ ওই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় না।’

আমিন হোসেন থাকেন ইতালিতে। দেশে আসি আসি করেও আসা হয় না। মায়ের মৃত্যুর খবর শুনেই টিকিট কাটেন। কিন্তু দেশে ফিরতে পারেন ৯ মার্চ। দেশে ফিরেও মায়ের দেখা পেলেন না আমিন হোসেন।

আমিন হোসেন বললেন, ‘আর দুটো দিন আগে আসতে পারলেও মাকে শেষবারের মতো দেখতে পারতাম।’