ওমরায় একা দুজনে (প্রথম পর্ব)

কাবার তাওয়াফ ও নিজের আত্মপরিচয়ের সন্ধান

(ওমরা করতে আমি ও আমার স্ত্রী—দুজনই গিয়েছিলাম। কোনও হজ্জ এজেন্সির কাফেলা বা কোনও মুআল্লিমের সঙ্গে নয়। এ জন্য এ সফরের নাম দিয়েছি— ‘ওমরায় একা দুজনে’। এ সফরনামায় আমি বর্ণনা করার চেষ্টা করবো, কেউ যদি কাফেলা বা মুআল্লিম ছাড়া একা বা দুজনে অথবা পরিবার নিয়ে ওমরায় যেতে চান তাহলে কীভাবে ওমরা পালন করবেন। ওমরার কার্যাবলী খুব সহজ ও সিম্পল। আশা করি এ ধারাবাহিক সফরনামা পড়ে আপনি নিজে নিজেই ওমরা পালনের অনুষঙ্গগুলো জেনে নিতে পারবেন।)

কাবা শরিফ প্রথম দেখার অনুভূতি কেমন—এটা বুঝতে হলে নিজেকে শিশু হিসেবে কল্পনা করুন। যে শিশুটি সমাজের আর দশটা শিশুর মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের। হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে শিশুটি দেখতে পেলো, তার বাড়ি বোঝাই শত শত বাহারি খেলনা। তখন শিশুটির অবস্থা কেমন হবে?image(1)

আমার অবস্থা ঠিক এমনই হলো—বাকরুদ্ধ, অনুভূতিহীন, মাথার ভেতরটা যেন ফাঁকা। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার ভেতরের অনুভূতি কী। শুধু মনে হলো, ‘আমি পাইলাম, আমি তাহাকে পাইলাম।’

ভেতরের অনুভূতিকে চাপা দিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী তাওয়াফ শুরু করলাম। তাওয়াফ শুরু করতে হয় কাবাঘরের যে কোণায় হাজরে আসওয়াদ (কৃষ্ণপাথর) রয়েছে, সেই কোণা থেকে। কাবাঘরকে সাত চক্কর দিয়ে আবার এখানে এসেই শেষ করতে হবে তাওয়াফ।

আমাদের সঙ্গে ফয়জুল্লাহ ভাই রয়েছেন। তিনি এর আগে বেশ কয়েকবার ওমরা করেছেন। তিনি আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সাধারণ নিয়মগুলো।

আমরা তাওয়াফ করছি। হাজিদের খুব বেশি ভিড় নেই। সবার পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে ঐকতানে চক্রাকারে ঘুরছি। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে, আস্তে বা জোরে। অনেকে দোয়ার বই নিয়ে এসেছে। তাওয়াফ করতে করতে বই দেখে পড়ে নিচ্ছে দোয়াগুলো। মালয় বা ইন্দোনেশিয়ানরা ২০-৩০ জনের দল বেঁধে আসে। তারা দোয়াও পড়ে একসঙ্গে। একজন আগে আগে বলে দিচ্ছে, বাকিরা সমবেত কণ্ঠে সেটার পুনরাবৃত্তি করছে।

যদিও তাওয়াফ করার সময় নির্দিষ্ট কোনও দোয়া নেই। আরবিতে দোয়া করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। আমি কখনও আরবি দোয়া, কখনও বাংলায় নিজের মনের অনুভূতিগুলো বলতে লাগলাম আল্লাহর কাছে। আজ সেই সুযোগ এসেছে। আল্লাহর প্রিয়তম ঘরকে কেন্দ্র করে ঘুরে ঘুরে তাকে বলতে চাই সকল কথা। যে কথাগুলো লজ্জায় বলতে পারিনি কখনও, লৌকিকতার মিথ্যে অভিমানে যেসব কথা বুকের গহীনে চাপা পড়ে গেছে, আজ সেসব কথা অর্গল খুলে বলতে চাই তোমার সকাশে। আজ তোমার ও আমার মধ্যে খসে গেছে সকল পর্দার দূরত্ব।image(2)

কী দোয়া পড়বো আমি যেন ভুলে গেছি। তাওয়াফ করতে করতে আমি বারবার শুধু কালো গিলাফে ঢাকা পাথুরে কাবার দিকে তাকিয়ে আছি। নিজেকে নিজে বলছি, ‘কী সৌভাগ্য আমার! হায় আল্লাহ, আমার মতো ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, নগণ্য এক মানুষকে তুমি তোমার কাবাঘরে নিয়ে এলে। আমার কী ছিল সাধ্য এমন!’

কাবাঘরের এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। এই কাবা মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখে। এটা আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম আরও কয়েকদিন পর, যখন মক্কা ছেড়ে মদিনার দিকে রওনা হই। সে ঘটনা পরে বলবো।

কাবাকে কেন্দ্র করে সাত চক্কর দিয়ে তাওয়াফ শেষ করলাম। তাওয়াফ করতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগলো। তাওয়াফের সময় আমাকে অভিভূত করল আরেকটি জিনিস—মানুষের মিলনমেলা। কত দেশ থেকে কত বর্ণ ও ভাষার মানুষ এখানে একত্রিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই। সাদা ইহরাম বেঁধে একই অভীপ্সা নিয়ে বিনীত হয়ে সবাই তাওয়াফ করছে একই কাবা। তাদের কারও সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই। কিন্তু এই কাবাঘরকে ঘিরে থাকা চারপাশের চত্বরে সমবেত হওয়া সকল মানুষকে মনে হচ্ছে আমার কত আপনজন। এদের যেন আমি জন্মান্তর ধরে চিনি।

কেউ এসেছে উপমহাদেশ থেকে, কেউ মালয় সাগরের পাড় থেকে, তুর্কি, চেচেন, তাজিক, আফ্রিকান আর আরবরা তো আছেই। এই সকল জাতিসত্ত্বা আর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের মানুষের একটা কমন পরিচয় হলো—তারা মুসলিম। আর এখানে তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে—কাবাঘরের তাওয়াফ। একই খোদার কাছে নত হওয়া। এই তাওয়াফের মাধ্যমে তারা তাদের আত্মপরিচয়কে সুসংহত করে নিচ্ছে।image(3)

কাবাঘরে তাওয়াফ শেষে আমার মনে হলো, কোনও মুসলিম যদি কখনও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগে, সে যেন একবারের জন্য হলেও কাবাঘর তাওয়াফ করতে আসে। যদি কখনও মনে হয়—কে আমি? আমার মুসলমান হওয়ার বিশেষত্ব কী? কেন আমি অন্য ধর্মের মানুষের চেয়ে বিশেষ? কেন নবীজি (সা.) আমাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলেছেন আর কেনই বা বলেছেন—প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। এসব প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে এই কাবাঘর ও চত্বরে।

তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিলাম। এটি সুন্নত। এছাড়া ওমরার আবশ্যিক কার্যাবলী সামান্য। এগুলো পূর্ণ হয়ে গেলে আপনার ওমরা পূর্ণ হয়ে যাবে।

ওমরার ফরজ দুটি

১.  ইহরাম বাঁধা (পরা)। দু প্রস্থ সেলাইবিহীন সাদা কাপড়কে ইহরাম বলে। যেটা আপনি বাংলাদেশ থেকেও পরে যেতে পারেন অথবা বিমানে বসেও পরতে পারেন। জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণের আধঘণ্টা আগে বিমান থেকে ঘোষণা করা হয়—‘যারা ওমরা করতে এসেছেন তারা এখান থেকে ইহরাম বাঁধতে পারেন।’ এটাকে বলা হয় মিকাত। শুধু পুরুষদের ইহরাম পরতে হয়। নারীরা সাধারণ বোরকা পরলেই হয়।

২.  ইহরাম পরা অবস্থায় তাওয়াফ করা। নারীরা বোরকা পরে তাওয়াফ করেন। তবে মুখ খোলা রাখতে হয়। অনেক নারী মাথায় ক্যাপ পরে তার ওপর একটি কালো কাপড় রেখে দেন। যাতে কাপড়টি মুখে না লাগে। নেকাব পরেও অনেকে তাওয়াফ করেন। তবে তাওয়াফের সময় চেহারায় কাপড় লাগানো, অনেকে এটাকে মাকরুহ বলেছেন।

ওমরার ওয়াজিব দুটি

১.  সাফা-মারওয়া সাঈ করা।

২.  মাথা মুন্ডিয়ে ফেলা অথবা চুল একদম ছোট করে ছেঁটে ফেলা।

ব্যাস, এ কাজগুলোই ওমরার আবশ্যিক কাজ। এ কাজগুলো সম্পন্ন করতে বড়জোর এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এগুলো হয়ে গেলে আপনার ওমরার ফরজিয়ত আদায় হয়ে যাবে। বাকি যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো সুন্নত ও মুস্তাহাব।

ছবি: লেখক

(দ্বিতীয় পর্ব আগামী সপ্তাহে)