ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কি জাকাত দেওয়া যাবে?

স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি অঞ্চল। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দু’টি দেশে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন লক্ষাধিক। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ওইসব অঞ্চলের প্রায় সকল শ্রেণির মানুষ। এই পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়ানো ও সহযোগিতা করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অর্থ, খাদ্য, ওষুধ, পোশাক ইত্যাদি দিয়ে তাদের সহযোগিতা করছেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে—ভূমিকম্প ও এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে কি জাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে? সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে বিশ্বের বড় বড় ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও স্বনামধন্য কয়েকজন ইসলামি স্কলার।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স—মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিশ্বের অন্যতম একটি ইসলামি সংস্থা। এখান থেকে জারি করা এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে– ‘ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে নিজেদের বাড়িঘর, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ, স্বজন-পরিজন সবাইকে হারিয়েছেন। শরিয়তে জাকাতের যে খাতগুলো আছে, ক্ষতিগ্রস্তরা একসঙ্গে সেগুলোর কয়েকটিতে ঢুকে পড়েছেন। যেমন: দরিদ্র, ঋণগ্রস্ত ও সহায়-সম্বলহীন। আর এই তিন শ্রেণির মানুষকে জাকাত দেওয়া বৈধ।’

এক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারসের সেক্রেটারি জেনারেল শায়খ আলি মুহিউদ্দিন কারাদাগি বলেছেন, ‘মূলত জাকাত নির্দিষ্ট একটি সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইবাদত। যখন সময় হয়, তখনই তা ফরজ হয়; অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর গচ্ছিত থাকলে, সেখান থেকে জাকাত আদায় করতে হয়। কিন্তু (শরিয়তের মূলনীতি এমন হলেও) প্রয়োজনের সময় এক বছর কিংবা অগ্রিম জাকাত আদায় করা বৈধ। যদিও ওই অর্থ-সম্পদ এক বছর গচ্ছিত থাকেনি।’

প্রয়োজনের সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগে অগ্রিম জাকাত দেওয়া জুমহুর তথা বেশিরভাগ ইসলামি স্কলার ও ফকিহগণের অভিমত বলেও দাবি করেন শায়খ কারাদাগি। এজন্য তিনি বিশেষত সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ভাই-বোনদেরকে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য-সহযোগিতার আহ্বান জানান। জাকাতের প্রসঙ্গ আসলেও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের শুধু জাকাত দিয়েই মুসলিমরা ক্ষান্ত হবে—সেই আশা করেন না শায়খ কারাদাগি; বরং সাধারণ দান-সদকা, উপহার-উপঢৌকন এবং জাকাত সবরকমের আর্থিক দান তুরস্ক ও সিরিয়ায় পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি। তার মতে– এই সহযোগিতা ও সহানুভূতি তাকওয়া ও পুণ্যের প্রতিযোগিতা।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে জাকাত দেওয়া প্রসঙ্গে মতামত দিয়েছেন আরব বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার শায়খ আজিল আননামশি। তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর আলেমদের নিয়ে গঠিত সংস্থা ‘শরিয়াহ স্কলার্স ইন দ্য গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল কান্ট্রিজ’-এর চেয়ারম্যান। এ সংক্রান্ত তার দেওয়া ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে কুয়েতের বিখ্যাত আরবি সংবাদমাধ্যম ‘আলআনবা’তে। ওই ফতোয়ায় তিনি বলেন, ‘তুরস্ক ও সিরিয়ায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ অগ্রিমও প্রদান করা যাবে। আর বড় বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে তারাই এখন এর সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। তারা তাদের বাড়িঘর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততিসহ সর্বস্ব হারিয়েছেন।’

 ‘ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তরা জাকাতের হকদার এ কারণে যে– তারা এখন দরিদ্র। একইসঙ্গে তারা সর্বস্বান্ত।’ বলেন শায়খ আজিল আননামশি। তিনিও শায়খ কারাদাগির মতো আশা করেন– মানুষ শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে জাকাতের ওপর নির্ভর করবে না; বরং জাকাতের পাশাপাশি সাধারণ দানও যেন সবাই করে তিনি সেই আহ্বান জানান।

ইসলামি গবেষণার আরও একটি বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘মারকাযুশ শুহুদ আলহাদারি লিদ-দিরাসাতিশ শারইয়্যাহ ওয়াল মুসতাকবিলিয়্যাহ’। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শায়খ ডক্টর ওয়াসফি আশুর আবু জায়েদ। তিনি তার ফতোয়ায় বলেন, ‘দেশ দু’টিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রিম জাকাত দেওয়া যাবে।’ একইসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, অগ্নিকাণ্ডের মতো মুসলমানরা যে প্রাকৃতিক ও গণদুর্যোগগুলোর শিকার হয়, সেসব ক্ষেত্রে (তাদের সুবিধার্থে) অগ্রিম জাকাত দেওয়াটা প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে।’

‘আলমাজলিসুল ইসলামিয়্যু লিল-ইফতা’ আরও একটি বড় ইসলামি গবেষণা সংস্থা। ফিলিস্তিনের অধিকৃত শহর উম্মুল ফাহমে এর সদর দফতর। সেখান থেকেও এ সংক্রান্ত একটি ফতোয়া জারি করা হয়েছে– তাতে বলা হয়েছে, ‘তুরস্ক ও সিরিয়ায় যে কঠিন পরীক্ষা ও চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে তা সেখানকার উপযুক্ত লোকদের মধ্যে অগ্রিম জাকাত প্রদানের ন্যায্যতা দেয়। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনও বৈধ সংস্থার মাধ্যমে জাকাত প্রদান করতে হবে, যারা উপযুক্ত ও সঠিক মানুষদের কাছে তা হস্তান্তর করবে।’

সূত্র: আলজাজিরা মুবাশির

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।