ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি হেফাজতের

হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী

সংসদে উত্থাপিত আগামী অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে  হেফাজতে ইসলাম। ব্যাংকে আমানতের ওপরে আবগারি শুল্ক আরোপ করে অর্থ সংগ্রহকে অন্যায়, গণস্বার্থ বিরোধী এবং লুটপাটের দায় মেটানোর প্রয়াস বলে উল্লেখ করেছে হেফাজত।  ব্যাংকে আমানতের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। সোমবার (৫ জুন) বিকেলে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এ দাবি জানান।

বিবৃতিতে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি নাকি জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট দিয়েছেন। অথচ বাস্তবে দেশের মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের দিক থেকে এটা সবচেয়ে কষ্টকর বাজেট। কারণ এই বাজেট কাজ পাওয়ার সুবিধা, সম্ভাবনাগুলোকে ছেঁটে ফেলার বাজেট। আমরা মনে করি জাতির দীর্ঘমেয়াদে উন্নতির জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও ধর্ম বিষয়ে সর্বাধিক ব্যয় বরাদ্দ পাওয়ার অগ্রাধিকার রাখে। কিন্তু, আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, স্বাস্থ্য খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা, মোট বাজেট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এবার ৭ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। গতবারের চেয়ে দশমিক চার শতাংশ কম।

হেফাজত মহাসচিব বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে সামগ্রিক ব্যয় শতাংশে কমেছে। এই বিভাগে সামগ্রিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ সংশোধিত বাজেটে তা ছিল ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এখানে বরাদ্দ প্রায় এক শতাংশ কমেছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি কমেছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। তবে এবারে এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।

মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, প্রাণ ও প্রকৃতির হেফাজত যে মানুষের একটি আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্য, তা যেন বর্তমান সরকার ভুলে বসে আছে। এই খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব থাকা উচিত ছিল। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গত বছর সংশোধিত বাজেট ছিল ৬০৬ কোটি টাকা। এ বছর হয়েছে ৬৫৯ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখালেও যেহেতু মূল বাজেটের আকার বেড়েছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ তাই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের শতকরা হারে বরাদ্দ ব্যাপকভাবে কমেছে। ধর্ম বিষয়ে সরকারের কেন এত বিমাতাসুলভ আচরণ, তা আমরা বুঝতে ব্যর্থ।

বিবৃতিতে হেফাজত মহাসচিব বলেন, আমরা গভীর হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সরকার ব্যাংক আমানতের ওপরে অতিরিক্ত আবগারি শুল্ক ধার্য করার মধ্যদিয়ে ভয়ানক এক তামাশা ও অনৈতিক কাজ করেছে। একজন মানুষ সরকারকে তার আয়ের ওপরে কর দিয়েই নিজের সঞ্চয় গড়ে তোলে। ইসলামের আদর্শ অনুসারে এই সঞ্চয়ের ওপরে হক সমাজের দুস্থ মানুষের। এই সঞ্চয়ের ওপরে সরকার দ্বিতীয়বার আবগারি শুল্ক ধার্য করে দুস্থ মানুষের হকেই যেন হাত দিতে চাচ্ছে। এতে করে ধনীরা ফরজ বিধান যাকাত আদায়ে আরও নিরুৎসাহিত হতে পারে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে যা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।  আমরা এটাকে তামাশা বলছি এই কারণেই যে, ইসলাম ধর্ম মতে সঞ্চয় একটি পবিত্র কাজ। অপচয় আর কৃপণতার মাঝখানে মধ্যমপন্থা হিসেবে মিতব্যয়ী হয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখা ইসলামের শিক্ষা। বস্তুত হালাল-হারামের বিধিনিষেধ মেনে খরচ সীমাবদ্ধ করতে হবে। প্রাচুর্যের সময় খরচের উৎসবে মেতে না উঠে, অপ্রয়োজনীয় কিংবা হারাম খরচ বাদ দিয়ে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করে উদ্বৃত্ত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে। যেন পরে নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাতার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়। যেমন, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “তুমি একেবারে (কৃপণতাবশে) ব্যয়-কুণ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে (অপব্যয়ী হয়ে) মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব  হয়ে বসে থাকবে”। (সূরা বনি ইসরাইল- ২৯)।

জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, অর্থনীতিতে আবগারি শুল্ক শব্দটার অর্থ “পাপ কর”। তার মানে, পরোক্ষভাবে সঞ্চয়কে পাপ কার্য বলে সরকার প্রতীয়মান করতে চাইছে। এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক; রাষ্ট্র কি নিজেই ধর্ম হয়ে উঠতে চায়?  বিড়ি সিগারেট মদ ইত্যাদি ক্ষতিকর জিনিসের ওপরে আবগারি শুল্ক ধার্য করা হয়। সঞ্চয়ের ওপরে আবগারি শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব শুধু তামাশাই নয়, বরং আমাদের বিশ্বাস আর ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে চরম বেয়াদবি।

হেফাজত মহাসচিব বলেন, আর্থিক কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে আছে কয়েক বছর থেকে। বাজেট বরাদ্দ দিয়ে এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও সরকার দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত (২০১৬-১৭ অর্থবছর বাদে) আট বছরে ক্রমবর্ধমান রাজস্ব  আয় থেকে সরকার রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিতে গড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ দিয়েছে। সাধারণ মানুষের ব্যাংক আমানতের ওপরে আবগারি শুল্ক আরোপ করে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করা হবে অদক্ষতা আর লুটপাটের দায় মেটাতে।

/সিএ/টিএন/