পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে খালেদা জিয়া যে মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছিলেন, সে ধারাগুলোকেই যুক্ত করা হয়েছে ইসিকে দেওয়া বিএনপির প্রস্তাবে। কোনও কোনও ধারাকে আরও বিস্তারিত করা হয়েছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার প্রস্তাবে একেবারে শেষের দিকে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সহায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইসিতে দেওয়া বিএনপির প্রস্তাবের শুরুতেই যোগ করা হয়েছে বিষয়টি। প্রস্তাবে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যথাসময়ে সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে। ইসিকে দেওয়া প্রস্তাবেও বলা হয়েছে, খুব শিগগিরই সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করে ইসিকে হস্তান্তর করা হবে।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে বলা ছিল, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যতিরেকে সুষ্ঠু অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন যেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে, তার জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। বিএনপির নতুন প্রস্তাবে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেশের আদালত বর্তমান সরকারকে অকার্যকর ও অপরিপক্ক বলে উল্লেখ করেছে। এই প্রস্তাবের শেষ দিকে রয়েছে, সংসদ নির্বাচনের ৯০ দিন আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে।
এছাড়া, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন; ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান; সীমানা পুনঃনির্ধারণ; অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি ইসির অধীনে পরিচালনা করার বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে ইসিতে দেওয়া প্রস্তাবে।
আরপিও’র কিছু আইনের সংশোধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ ও নতুন ভোটার নিবন্ধীকরণ, প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার করা, কারান্তরীণ থাকা নেতাকর্মীদের ভোটার হওয়া নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ধারাগুলোও রয়েছে বিএনপির নতুন প্রস্তাবে। নির্বাচনি বিধিমালা, নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়গুলোও দলটির ইসিতে দেওয়া প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের বাইরে রবিবার ইসিকে দেওয়া বিএনপির প্রস্তাবে কয়েকটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। এই ধারায় বিএনপি বলেছে, ‘নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপমুক্ত একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।’
বিএনপির এ প্রস্তাবের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও আন্তরিক বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা যে সংলাপ করছি, আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। আগামীতেও আলোচনার সুযোগ রয়েছে।’
বিএনপির প্রস্তাবে নতুন যুক্ত হয়েছে নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করার পূর্বশর্ত হিসেবে বন্ধ গণমাধ্যমগুলোকে খুলে দেওয়ার বিষয়টি। এছাড়া নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু রাখার বিষয়টিও বিএনপির প্রস্তাবে যুক্ত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার নভেম্বরের প্রস্তাবে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা না থাকলেও নতুন প্রস্তাবে এই অপরাধগুলো বন্ধ করতে ইসিকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হযেছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রবেশ নির্বিঘ্ন করার ক্ষেত্রে প্রবেশপত্র দেওয়ার কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে যাদের সঙ্গে সংলাপ করেছে, তাদের পরামর্শ ও সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জোর দাবিও বিএনপি জানিয়েছে ইসিকে দেওয়া প্রস্তাবে। এছাড়া, বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করার দাবিও বিএনপি ইসি’র কাছে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা তার প্রশংসা করেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এমনভাবে ভাবা উচিত হবে না। তবে ইসির উদ্যোগটিকে এ ক্ষেত্রে ভালো একটি সূচনা বলা যায়। বৈঠকে তারা ইতিবাচক ছিল, আমরাও ইতিবাচক ছিলাম।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব দলীয় সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে তৈরি হয়নি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সামগ্রিক অর্থে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন খুব জরুরি— এটি বিবেচনায় নিয়েই প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।’
আরও পড়ুন-
সরকারের ওপর ইসিকে প্রভাব বিস্তারের পরামর্শ বিএনপির