বিএনপি’র পরিষ্কার অবস্থান দেখতে চায় শরিক দলগুলো






২০ দলীয় জোটের বৈঠক (ফাইল ছবি)
‘খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবে না ২০ দলীয় জোট’—এমন অবস্থানে ঐক্যবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও শরিকেরা চান নির্বাচন প্রশ্নে দলীয় অবস্থান আরও পরিষ্কার করুক বিএনপি। বিশেষ করে দলীয় প্রার্থীদের গ্রিন সিগনাল দেওয়া, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার কানাঘুষা চলায় বিএনপিকে আরও স্বচ্ছ দেখতে আগ্রহী ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জোট সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির অবস্থান কেমন হবে, সেটা তারা নিজেরাই বলুক। আমাদের কাছে এমন কোনও বিষয় আসেনি।’

বিএনপি জোটের অন্তত চারজন শীর্ষ নেতা জানান, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি বা জোটের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এতে সব শরিকেরা একমত। সমস্যা তৈরি হয়েছে বিএনপির কতগুলো আচরণে। বিশেষ করে খালেদা জিয়া নির্বাচনে যেতে সম্মত হলে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতেই হবে। সেক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি কোন পদ্ধতিতে নেওয়া হবে তা এখনও পরিষ্কার করেনি জোটের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি।

জোটের সূত্র জানায়, এরই মধ্যে বিএনপি জোটের বৈঠকেই একটি শরিক দলের সিনিয়র নেতা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কারও অনুপস্থিতিতে সংসার বন্ধ থাকে কিনা।’

জোটসূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ আগেই এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থকে মৌখিকভাবে তাদের নিজ নিজ এলাকার সংসদীয় আসনে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেন। এই তিন নেতা ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট থাকলেও জোটের বাকি নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে অস্থিরতা রয়েছে।

শরিক একটি দলের চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিনজন সিনিয়র নেতাকে মৌখিকভাবে বলায় তারা মানসিক শান্তিতে রয়েছেন। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অস্থিরতা থাকবে।’

জোটসূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের বাইরে আরও একাধিক কারণে বিএনপির ওপর সন্দেহ বাড়ছে শরিকদের। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করেন একনেতা।

জোটসূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনের আগে ঠিক কবে থেকে প্রস্তুতি শুরু করবে বিএনপি, নির্বাচন নিয়ে দলটির এই মুহূর্তের ভাবনা কী, খালেদা জিয়া মুক্ত না হলে কী হবে, নির্বাচনের প্রশ্নে বিদেশিদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ— এসব বিষয়ে অন্ধকারে শরিক দলগুলো।

এর বাইরে রয়েছে কিছু রটনাও। জোটের এক শরিক দলের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাজারে রটনা আছে, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করতে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও আমাদের প্রতিবেশী দেশ আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। তারা এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে একটি সমঝোতার তৈরির চেষ্টা করছে।’
এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘যদি সমঝোতা হয় তাহলে কতগুলো আসনের ভিত্তিতে হবে, এরপর বিএনপি কতগুলো পাবে, জোটের শরিকেরাই বা কত পাবে— এসব বিষয়ে বাজারের আলোচনা আছে।’ এই নেতার ভাষ্য, ‘আমরা এসব বাজারি কথা বিশ্বাস করতে চাই না। আমরা চাই বিএনপি তাদের অবস্থান আমাদের সামনে তুলে ধরুক।’

শরিক আরক দলের শীর্ষ একনেতা বলেন, ‘সব সন্দেহ দূর করার একমাত্র যৌক্তিক অবস্থান রয়েছে কেবলমাত্র বিএনপির। নির্বাচনের আগে আগে আসন দিলে তো খুব ভালো ফল আসবে না। আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ফলে নির্বাচনে গেলে তাদের শরিকদের কতগুলো আসন দেওয়া হবে, তার একটি নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।’

গত মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিজেও এ প্রশ্ন তুলেছেন, ’৬০ জন বা ৯০ জন ভাগ্যবান ব্যক্তি বিএনপিতে কারা? কাদের শেখ হাসিনা সিট দিতে চান? যে ৯০ জনকে সিট দেবে বিএনপি, আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে চাই, সেই ৯০ জন অবশ্যই খালেদা জিয়ার লোক নন, তারেক রহমানের লোক নন। সেই ৯০ জন আদৌ বিএনপির কী, সেই প্রশ্নটি আমি করি।’

জোটের শরিক একটি দলের মহাসচিব বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে যে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, এরইবা নিশ্চয়তা কী!’

একটি ইসলামী দলের প্রধান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবেই, খালেদা জিয়া মুক্ত হন বা না হন, ধারাবাহিকতা রাখতে তারা নির্বাচনে যাবে। কারণ, নির্বাচন যেকোনও মাত্রারই হোক না কেন, শক্তিশালী বিরোধী দল তো হবে। আর নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হলে তো ক্ষমতায়ও যেতে পারে।’

এ বিষয়ে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি অবস্থান পরিষ্কার করবে না। এটার সময় আসেনি। সময়মতো বিএনপি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে আশা করি। সময়মতো আন্দোলন হবে, সময়মতো সবকিছু হবে।’

জোটের একাধিক নেতা জানান, বিএনপির মধ্যে একটি অংশ জোটকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চাইলেও আরেকটি অংশ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির কারণে শরিকদের বাদ দেওয়ার পক্ষে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একনেতা জানান, এই সমস্যার কারণেই নজরুল ইসলাম খানকে বিএনপি জোটের সমন্বয়ক করা হয়েছে। বিশেষ করে মনোযোগ দিতে জোটে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।

ওই নেতার ভাষ্য, জোটকে আরও যৌক্তিক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে এবং সমস্যাগুলো দূর করতেই নজরুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর অনেক বেশি সাংগঠনিক দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় নজরুল ইসলামকে জোটে আনা হয়েছে।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য একনেতা জানান, জোটকে শক্তিশালী করতে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ভেতরে ভেতরে চলছে। এই কমিটি গঠনের কাজটিও দ্রুত সামনে আসতে পারে। এই নেতা জানান, জোটের শরিক দলগুলোর কয়েকজন সিনিয়র, দায়িত্বশীল রাজনীতিকের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি নজরুল ইসলাম খানকে সহযোগিতা করবে।