ধানের শীষে একাকার ঐক্যফ্রন্ট-জামায়াত

ধানের শীষ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জামায়াত

শরিক হিসেবে জামায়াতে ইসলামী না থাকলেও একসঙ্গে কাঁধ মিলিয়েই জাতীয় নির্বাচন করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নির্বাচনি প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থিতার বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট আরও আগে সিদ্ধান্ত নিলেও জামায়াতের বিষয়টি ঝুলন্ত ছিল। মঙ্গলবার (২৭ নভেম্বর) মধ্যরাতে বিএনপির সঙ্গে দফায় (প্রতীক নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নাটকীয়তা) দফায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে যে, জামায়াতও ধানের শীষ প্রতীকেই নির্বাচন করবে।

বুধবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ২৫ জন প্রার্থীকে ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আরও ৪-৫টি আসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে নির্বাচনি প্রতীক ধানের শীষই থাকছে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক শরিকের আপত্তির মুখেও বিএনপি তার জোটসঙ্গী জামায়াতকে ধানের শীষে নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়েছে।  মঙ্গলবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী একজন নেতা জানান, শুনেছি ঐক্যফ্রন্টের কেউ কেউ আমাদের ধানের শীষ দেওয়ার বিপক্ষে। পরে ঐক্যফ্রন্টের দুটি দলের দুই শীর্ষ নেতা দাবি করেন, তারা এ বিষয়টি জানিয়েছিল বিএনপিকে। পরে অবশ্য এ নিয়ে সুরাহা হয়েছে।

গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগেও আলোচনায় ছিল—জামায়াতের সঙ্গে কোনও ঐক্য হচ্ছে না। এমনকি জোটের অন্যতম প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী, আসম রবসহ প্রগতিশীল রাজনীতিকরা জামায়াতের সঙ্গে কোনও ঐক্য হচ্ছে না, এমনটি বলে এসেছেন। ঐক্যফ্রন্টের প্রত্যেকটি সভা ও সমাবেশে জোর দিয়েই নেতারা বলেছেন, ঐক্যে জামায়াত নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত যে মার্কায় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন করবে, সেই ধানের শীষ নিয়েই প্রার্থিতা করবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামায়াত। 

গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইসিতে চিঠিটি জমা দেয়। ওই চিঠি জমা দেওয়ার পর সুব্রত চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি—ঐক্যফ্রন্টভুক্ত শরিকরা যার যার দল থেকে নির্বাচন করবে এবং প্রতীক হিসেবে ধানের শীষ ব্যবহার করবে। এর আগে মাহমুদুর রহমান মান্নাও সাংবাদিকদের জানান, ঐক্যফ্রন্ট ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবে।

বুধবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে আমাদের প্রতিবেদক রাফসান জানি জানান, ঢাকা-১৫ আসন থেকে ধানের শীষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার (বীর প্রতীক) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছি বিএনপি এবং আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে। বিএনপি তাদের শরিক দলের সঙ্গে কী করবে, এটা তাদের ব্যাপার। আর জামায়াত বলতে যেটা বুঝাতে চাচ্ছেন, তা হলো এখন আর জামায়াত নামে কোনও দল নির্বাচন করতে পারবে না। এই দলটিকে কোনও না কোনও মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তারা যে দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবে, তখন তারা সেই দলের সদস্যও হয়ে গেলো। সুতরাং জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি কী করবে এটা তাদের বিষয়, এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিষয় হলো—জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের শরিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করবো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ক শহীদুল্লাহর কায়সার বলেন, ‘আমাদের ঐক্য হয়েছে বিএনপি সঙ্গে। এখন বিএনপি তাদের দল থেকে কাকে মনোনয়ন দেবে সেটা তাদের ব্যাপার। এতে ঐক্যফ্রন্টের কোনও সমস্যা নেই। তারপরও ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হলে সেখানে হয়তো এই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে জোটগতভাবে নির্বাচন করার জন্য। জামায়াত ২০ দলীয় জোটে আছে, যে জোটের নেতৃত্বে আছে বিএনপি। এছাড়া, প্রতীকে একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করেছে, তাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই বিষয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে। 

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে রেখেই জাতীয় ঐক্যফন্ট গঠন করেছে। ফলে ২০ দলীয় জোটের নেতারা নির্বাচনের জন্য ধানের শীষ প্রতীক বেছে নিয়েছেন। আর জামায়াতের যেহেতু কোনও নিবন্ধন নেই, তাই তারা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চায়। আমি মনে করি এতে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনও সমস্যা হবে না। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য হয়েছে বিএনপির সঙ্গে, জামায়াতের সঙ্গে নয়।’

শামসুজ্জামান দুদু আরও বলেন, ‘নানাভাবে ঐক্যফ্রন্টকে সাম্প্রদায়িক জোট হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। এখন তো আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাও কওমি জননী উপাধি পেয়েছেন। অতীতে জামায়াতকে পাশাপাশি নিয়ে আন্দোলনও করেছেন। জামায়াতের সঙ্গে অন্যরা থাকলে সমস্যা। ভোটের বাজারে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। বরং সংকটের মুখে সরকার। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যেভাবে ঘনীভূত হয়েছে, তাতে করে আওয়ামী লীগের বড় বিপর্যয় হতে পারে।’

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘জোটের প্রার্থী হিসেবেই জামায়াতের প্রার্থীরা ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। এতে কোনও সমস্যা আছে বলে আমরা মনে করি না।’

জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে ২৫টি আসনে জোটগত মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। আরও চারটি আসনে জোটগত মনোনয়নের চেষ্টায় আছে জামায়াত।

অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানান, ২৫টি আসনে জামায়াতের প্রার্থী হলেন—আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদত হোসাইন (যশোর-২), আব্দুল ওয়াদুদ (বাগেরহাট-৩), আবদুল আলীম (বাগেরহাট-৪), মিয়া গোলাম পরওয়ার (খুলনা-৫), আবুল কালাম আযাদ (খুলনা-৬), রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), আব্দুল খালেক (সাতক্ষীরা-২), গাজী নজরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা-৪), শামীম সাঈদী (পিরোজপুর-১), ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী (সিলেট-৫), হাবিবুর রহমান (সিলেট-৬), শফিকুর রহমান (ঢাকা-১৫), আব্দুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও-২), মোহাম্মদ হানিফ (দিনাজপুর-১), আনোয়ারুল ইসলাম (দিনাজপুর-৬), মনিরুজ্জামান মন্টু (নীলফামারী-২), আজিজুল ইসলাম (নীলফামারী-৩), গোলাম রব্বানী (রংপুর-৫), মাজেদুর রহমান সরকার (গাইবান্ধা-১), রফিকুল ইসলাম খান (সিরাজগঞ্জ-৪), ইকবাল হুসেইন (পাবনা-৫), মতিউর রহমান (ঝিনাইদহ-৩), সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের (কুমিল্লা-১১), হামিদুর রহমান আজাদ (কক্সবাজার-২), শামসুল ইসলাম ( চট্টগ্রাম-১৫)।

এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলসহ আরও অন্তত পাঁচটি আসনে জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত। ৯ ডিসেম্বরের আগে সবকিছু চূড়ান্ত হতে পারে।

এদিকে, বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন হওয়ায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট শরিকদের চূড়ান্ত সংখ্যাটি জানা যায়নি। ফ্রন্টের সিনিয়র নেতারাও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় শেষ তথ্য জানা যায়নি।