দলীয় ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়ে এসে ভবিষ্যত রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। আসন্ন এই নতুন রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারিত হচ্ছে দুটো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বর্তমান প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী দিনে দল পরিচালনা ও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে চায় বিএনপি। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০ বছরের রাজনৈতিক জোটসঙ্গী জামায়াতকে বাদ রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে শক্তিশালী করবে দলটি। এ লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আস্থায় আনতে চায় দলের হাইকমান্ড।
বিএনপির হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল ও জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে একইসঙ্গে কয়েকটি সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই সমস্যাগুলোকে বাস্তবসম্মত উপায়ে সমাধান করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ কারণে একদিকে সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনৈতিক কৌশলও রপ্ত করতে চায় বিএনপি। সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথা হয়। আমার জানা মতে, তিনি চাইছেন একটি নতুন রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে। এ কারণে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার কাজটি শুরু হয়েছে। তারা নিজে থেকে সরে গেলে ভালো। না গেলেও পরিস্থিতির কারণেই তাদের যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট আমরা গঠন করেছি এবং ড. কামাল হোসেনকে লিডার করেছি। এটা-তো আমাদের সেই স্পিরিটের অংশ।’
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, ‘বিএনপি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের দল। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করার মধ্য দিয়ে এই জায়গাটি নষ্ট করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠন হওয়ার মধ্য দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্যতা তৈরি হয়।’
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘জামায়াতে ইসলামীকে যুক্ত করা হয়েছিল দুইজন ব্যক্তির তৎপরতায়। এখন দুজনেই প্রয়াত। তারা হলেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ এবং সাংবাদিক-রাজনীতিক আনোয়ার জাহিদ। এই দুজনের অসামান্য তৎপরতায় খালেদা জিয়ার কাছে জামায়াতকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়। একইসঙ্গে একটি জাতীয় দৈনিকের ভূমিকাও ছিল অনেক।’
কাজী জাফরের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দাবি করেন, ১৯৯৯ সালে জোট গঠনের আগে প্রায়শই খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার যাতায়াত ছিল। কাজী জাফর ওই নেতাদেরকে তার আত্মীয় বলে খালেদা জিয়ার বাসায় নিয়ে যেতেন। একই সময়ে আনোয়ার জাহিদের প্রচেষ্টাও ছিল উল্লেখযোগ্য। কাজী জাফরের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘চার দলীয় জোট গঠনে কাজী জাফরের অবদান অনেক বেশি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১৯৯৯ সালেই খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে এসে প্রথমেই বলেন, ‘আজকে আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে কথা দিতে হবে, আপনারা এই সিদ্ধান্ত মানবেন।’ ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার প্রেস সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘বি চৌধুরী ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারবেন না।’
চার দলীয় জোট গঠনের পর এক বছরের মাথায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। সরকার গঠনে যুক্ত করে জামায়াতকেও। বিএনপির অনেক নেতার উপলব্ধি— জামায়াতকে আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারে যুক্ত করা ছিল রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। আন্দোলনের ঐক্য নির্বাচনের পর হয়ে গেলো সরকারের ঐক্য। আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারে অংশগ্রহণ করানোর পেছনে কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন সাংবাদিক অনোয়ার জাহিদ।
স্থায়ী কমিটির দুইজন সদস্য বলছেন, কিচেন কেবিনেটে সাইফুর রহমান ও মান্নান ভুঁইয়ার হোসেনের দ্বন্দ্ব ছিল। সংসদে উপনেতা হওয়ার লড়াইয়ে তাদের দ্বৈরথ ছিল তুঙ্গে। একইসঙ্গে তাদের বিরোধে কেএম ওবায়দুর রহমান উপনেতা হতে পারেননি। একইসঙ্গে তৎকালীন মহাসচিব মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে বিরোধ ছিল ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের। এই বিরোধ দেখা দেয় ৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে। মোশাররফ হোসেন মহাসচিব হওয়ার দৌঁড়ে ছিলেন। ফলে মান্নান ভুইয়া মহাসচিব হলেও বিএনপির জ্যেষ্ঠনেতাদের বিরোধ ছিল প্রবল। ওই সংসদে বিএনপি পাঁচ বছর কোনও উপনেতা নির্বাচন করেনি।
স্থায়ী কমিটির দুই প্রবীণ সদস্য মনে করেন, ওই সময় জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফল স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিট ও গুণগত পরিবর্তনের পথ থেকে সরে যায় বিএনপি। জঙ্গি বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান ইস্যুতে বিএনপির হাইকমান্ডের তৎকালীন অবস্থান ছিল নিষ্ক্রিয়। উল্টো ওই পরিস্থিতিতে ‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃ্ষ্টি’ উল্লেখ করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন ওই সরকারের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী। ওই সময় কার্যত নিজামী, মুজাহিদের বক্তব্যের মূল্য দিতে হয়েছে বিএনপিকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, দলের প্রথম কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির প্রথম সখ্যতা তৈরি হয় ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের সময়। ১৭টি আসন পেয়ে বিএনপিকে সমর্থন করার পরই দলের হাইকমান্ড তাদেরকে আস্থায় নেয়।’
জমির উদ্দিন সরকারের এমন ভাষ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাদের মন্তব্য— ‘ওই সময় রাশেদ খান মেননদের সমর্থন গ্রহণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। তৎকালীন বিএনপি নেতা বি চৌধুরীর বাসায় সরকার গঠনে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে অনেকটাই অগ্রগতি হয়। যদিও ওই সময় বিএনপির তিন প্রভাবশালী কট্টর ডানপন্থী নেতার উদ্যোগ ও আগ্রহে শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সমর্থন গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া।’
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘১৯৯১ সালের সরকার গঠনে জামায়াতের সমর্থন পেলেও গোলাম আজমকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ওই দূরত্ব কাজে লাগিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ায় আওয়ামী লীগ। ফলশ্রুতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব, আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে সক্রিয় সহযোগিতা করে জামায়াত।’
বিএনপির একজন মধ্যম সারির নেতা মনে করেন, গোলাম আজমকে গ্রেফতার করলেও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে উপলব্ধিতে নিতে পারেনি বিএনপির তৎকালীন নেতৃত্ব। যে কারণে অদ্যাবধি, বিশেষ করে এখনও জামায়াতকে সঙ্গে রাখায় বিএনপিকে দায় নিতে হচ্ছে।
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন মনে করেন, ‘ভোটের হিসাবে জামায়াতকে সঙ্গে রাখার তাৎপর্য আছে।’
জমির উদ্দিন সরকারের উপলব্ধি এমন হলেও বিএনপির হাইকমান্ডের উপলব্ধি— বাংলাদেশে আগামীতে ভোটের হিসাব-নিকাশে নির্বাচন হবে না। সেক্ষেত্রে আগাম ভবিষ্যতের কৌশল হিসেবেই ভোটের বিষয়টিকে ‘জুজুর ভয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দৃশ্যত এখনও বিএনপি ও জামায়াত দুপক্ষ সখ্যতার সম্পর্কের ইতি টানতে না চাইলেও ভেতরে-ভেতরে ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ইতিহাসের আলোকে আলোচনা হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সমস্যা এখন বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নয়। সমস্যা হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র নেই, স্বাধীনতা নেই। সরকার অস্বস্তিতে আছে। ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে সমস্যায় আছে তারা। আমি মনে করি, বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে এবং স্বাভাবিক রাজনীতি চালিয়ে যেতে হবে।’
এরমধ্যে জামায়াতের ভেতরে একাত্তরের বিরোধিতার কারণে দল বিলুপ্ত করে নতুন সংগঠন করার প্রস্তাব ওঠেছে। দল থেকে পদত্যাগ করেছেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তবে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের বিষয়ে বিএনপি-জামায়াতের রয়েছে দুই অবস্থান। বিএনপি ও জামায়াত— উভয়ের কেউই নিজে থেকে সম্পর্কের ইতি টানছে চাইছে না। দুই দলের নেতারাই বলছেন, আমরা ছাড়বো না, তাদের ছাড়তে হবে। ২০ বছরের সম্পর্কের সমাপ্তি খুব সহজেই ঘটবে, এমনটি মনে করছেন না নেতারা।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতকে রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান সব সময়ই ছিল ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা কেন ছাড়বো। তারা ছাড়ুক।’
বিএনপি জোট ছেড়ে দিচ্ছে জামায়াত, এমন প্রশ্নে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতের চিন্তা এরকমই। চিন্তা-ভাবনা এরকম। বিএনপি জোটকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। তবে মজলিসে শুরা থেকে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি।’
বাংলা ট্রিবিউনকে কয়েকদিন আগে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘জোট তো গোপনে ভেঙে দেওয়ার কিছু নেই। জোট ছাড়লে আমরা প্রকাশ্যই জানাবো।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নতুন বার্তা
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এরইমধ্যে দলের নতুন উপলব্ধি নিয়ে হাজির হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ৪ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসার উপলক্ষে সিঙ্গাপুর গেলেও মূল লক্ষ্য তার ভিন্ন। গত দুয়েকদিনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এফএসি) একজন সদস্য। এই সফরে মির্জা ফখরুলের অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও লন্ডন সফরের কথা রয়েছে। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা রয়েছে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন এফএসির একাধিক সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, মির্জা ফখরুল সিঙ্গাপুর গেছেন। সেখানে তিনি চিকিৎসা করাবেন।’ বিএনপির আন্তর্জাতিক উইং এরইমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।’
বিদেশ বিষয়ক কমিটির একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মির্জা ফখরুলের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এই সফরে তিনি বিএনপির নতুন উপলব্ধি, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় এবং বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় নির্বাচন, মানুষের ভোটাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে আলোচনা করছেন। যদিও এ বিষয়ে কোনও নেতাই উদ্ধৃত হতে চাননি।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: