স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা বলছেন, মূল দল বিএনপি থেকে তাদের জন্য কোনও আর্থিক বরাদ্দ নেই। ফলে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর এসব কার্যক্রম নির্ভর করে।
নেতারা আরও জানান, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই প্রাধান্য দিতে হয়। আবার এই রাজনৈতিক কারণেই অনেক কর্মসূচি দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা হয়ে ওঠে না।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যক্তিগত ও সংগঠনের উদ্যোগে আমরা যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। আসলে এগুলো মূলত সরকারি দলের কাজ। আমাদের দল ক্ষমতায় থাকলে আমরাও সরকারের অনুদান নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতাম।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সংগঠনের ব্যানারে অনেক দুর্যোগের ঘটনায় হয়তো আমাদের কার্যক্রম ছিল না। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে আমরা যে যার মতো করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
সংগঠনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া প্রসঙ্গে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবক দলের আদর্শ অনুসরণ করে চলি। আমাদের কোনও বিচ্যুতি নেই। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপরে সংগঠনের কার্যক্রম নির্ভর করে। স্বেচ্ছাসেবক দল যে শুধু স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করবে, তা কিন্তু নয়। আমাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করতে হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি থেকে আমাদের সংগঠনের জন্য নির্ধারিত কোনও আর্থিক বরাদ্দ নেই। তবে দেশে বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তখন পরিস্থিতি বুঝে একটা বরাদ্দ দেওয়া হয়।’
স্বেচ্ছাসেবক দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মীদের সমন্বয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলা হবে। সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, মহামারীসহ যে কোনও জাতীয় দুর্যোগ, দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় কাজ করবেন। কোনও কাজেই তারা ব্যর্থ হবেন না। অন্যরা যেখানে ব্যর্থ হবেন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে এগিয়ে যাবেন।’
কিন্তু বিএনপির রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই দলের অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল স্বেচ্ছায় সেবা দেওয়া তো দূরের কথা, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে মূল দলের আন্দোলন-সংগ্রামেও তাদের কোনও ভূমিকা নেই। ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি, আর আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আংশকি কমিটি ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরবর্তী একমাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয় তিন বছরের জন্য। এরইমধ্যে ২৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি ওই আংশিক কমিটির নেতারা। ফলে সংগঠনটির কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এদিকে, আংশিক কমিটির নেতারা বলছেন, যখন স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান কমিটি হয়, তখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রতি সপ্তাহে তিন-চারদিন করে আদালতে হাজিরা দিতে হতো। সংগঠনের নেতাকর্মীরা সবাই তখন সেদিকেই ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে খালেদা জিয়াও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার জন্য সময় দিতে পারেন নি। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। ফলে তার মুক্তি আন্দোলন করতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকে জেলে যেতে হয়েছে। এখনও সংগঠনের সভাপতি শফিউল বারী কারাগারে রয়েছেন। এরইমধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করে। সংগঠনের নেতারা তখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সংগঠনের কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ গ্রহণও করেছিলেন। এসব কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়ে ওঠেনি। তবে কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে, তারও কোনও দিনক্ষণও বলতে পারছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল বলেন, ‘আমাদের কমিটি হওয়ার পরে খালেদা জিয়া কোর্টে হাজিরা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে আমরাও ব্যস্ত ছিলাম। এরপর তো জাতীয় নির্বাচন এলো। এছাড়া, আমাকে এবং সভাপতিকে বেশ কয়েকমাস জেলে থাকতে হয়েছে। এই কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট তারিখ বলা না গেলেও বলতে শিগগিরই কমিটি করা হবে।’
গত ২৯ মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারার বিষয়ে ভিন্ন কথা বলছেন সংগঠনটির পদ-প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ— আগের কমিটির নেতাদের মতোই ‘কূট-কৌশল’ গ্রহণ করছেন বর্তমান কমিটির নেতারা। বিভিন্ন অজুহাতে আগের কমিটি তিন বছরের জায়গায় সাত বছর পার করেছিল। বর্তমান কমিটির নেতারাও আগের মতো নানা অজুহাতে কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ না করে মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টায় আছেন। ফলে পর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ার কারণে কেউ ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে যান না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আংশিক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, ‘নেতাকর্মীরা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। তবে মূল কথা হচ্ছে— বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করবা।’
প্রসঙ্গত, ১৯৮০ সালে সাংবাদিক কাজী সিরাজকে আহ্বায়ক করে ২৩ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন গঠন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর ১৯৮৫ সালের ১৯ আগস্ট কাজী আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ২৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির দুই দিনব্যাপী জাতীয় কাউন্সিলে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনকরা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম সংগঠটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়। ওই বছরের ১০ মার্চ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রুহুল কবির রিজভীকে সভাপতি ও ফজলুল হক মিলনকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়। তারা তিন বছরের জায়গায় টানা ১৩ বছর ধরে পদ-পদবিতে ধরে রেখে ছিলেন।
এরপর ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর হাবিবুন নবী খান সোহেলকে সভাপতি আর শরাফত আলী শপুকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। তারাও তিন বছরের জায়গায় সাত বছর পরে সম্মেলন দেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি আর আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়, সেই কমিটি দিয়েই চলছে স্বেচ্ছাসেবক দলের কার্যক্রম। এরই মধ্যে ২৯ মাস পার হয়েছে,তিবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে, আদৌ হবে কিনা, সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা তা কেউই জানেন না।