দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত মজলিসে শুরার একাধিক সদস্য জানান, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্যানেল-আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রবিবার (১৪ অক্টোবর) ভোট গণনা হয়। মঙ্গলবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল নেতাদের কাছে এ তথ্য পৌঁছে যায়। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে শুরার সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত প্যানেলের তালিকাসহ গোপন ব্যালট পৌঁছতে শুরু করবে রুকনদের কাছে। তাদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন নতুন আমির। চলতি মাসের মধ্যে আমির নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে। কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হিসেবে প্রায় দুইশ’ সদস্য আছেন বলে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। একই সঙ্গে সারাদেশে প্রায় ৪৫ হাজার রুকন রয়েছেন জামায়াতের।
জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্যানেল আমির হিসেবে প্রথমে আছেন ডা. শফিকুর রহমান। তিনি মনোনীত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে। এর আগে, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। ২০১২ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর শফিকুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পান। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সিঙ্গেল ডিজেটের ব্যবধান রয়েছে ভোটে। আরেক নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার আছেন তৃতীয় স্থানে। তবে গঠনতান্ত্রিকভাবে প্যানেল আমিরের বাইরে যেকোনও রুকনকেই ভোট দিতে পারবেন ভোটাররা। এক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ভোট পেতে পারেন। বর্তমানে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন দলে জনপ্রিয় এই নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা মহানগরীর নেতা অ্যাডভোকেট শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এখনও জানতে পারিনি। বাইরে-বাইরে অনেক আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে এখনও জানতে পারিনি। আগামী রবিবার বা সোমবারের দিকে জানা যেতে পারে।’
জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, ডা. শফিকুর রহমান প্যানেল নির্বাচনে এক নম্বর হওয়ায় আমির হিসেবে তাকেই ভাবছেন সাধারণ রুকনরা। সাধারণত, অতীতেও প্যানেলে যিনি এগিয়ে থাকতেন তিনিই দলের আমির হয়েছেন। ডা. শফিকের ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, গত ১০ বছর ধরে সবচেয়ে সংকটকাল অতিক্রম করছে জামায়াতে ইসলামী। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ধারার যে চর্চা তা বন্ধ রয়েছে। দলের ঐক্য ধরে রাখা ও সাবেক শিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। এ কারণে শুরা সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য বেড়েছে তার। যদিও আমির হিসেবে প্যানেলে মজিবুর রহমান এগিয়ে থাকবেন এমন আলোচনা কয়েকদিন আগেও শোনা গিয়েছিল। দলের অনেক কুশলী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্ত ভূমিকা রাখায় শফিকুর রহমানকেই পছন্দের শীর্ষে রেখেছেন শুরার সদস্যরা- এমন পর্যবেক্ষণ একাধিক দায়িত্বশীল নেতার।
দলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘ডা. শফিকুর রহমান আমির হলে দলে প্রথমবারের মতো তিনি শীর্ষব্যক্তি হবেন যার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনও অভিযোগ নেই। উপরন্তু দলে যারা স্বাধীন দেশের প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের মধ্যে প্রথম কাতারে তিনি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
দলের অনুসারীদের কেউ কেউ দাবি করছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি শফিকুর রহমান। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা জাসদ ছাত্রলীগের হাত ধরে। সিলেটের এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর সেখান থেকে পাস করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তি হওয়ার পর ছাত্র শিবিরে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে পরবর্তীতে তিনি শিবির সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে শহর ছাত্র শিবিরের সভাপতিও ছিলেন শফিকুর রহমান।’
শফিকুর রহমানের জাসদ ছাত্রলীগে যুক্ত থাকার বিষয়ে সিলেট এমসি কলেজের তৎকালীন নেতা, বর্তমানে জাসদের সিলেট মহানগরী সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক লোকমান আহমদ এ তথ্যকে ‘অসত্য’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতা হওয়ার পর ‘জাসদ ছাত্রলীগ করেছেন বলে শুনছি। আমি তার এক বছরের সিনিয়র। মেট্রিক পাস করে ১৯৭৪ সালে সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হন ডা. শফিক। আমিও তখন এমসি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমরা তাকে তখন কলেজে পাইনি। তিনি কীভাবে জাসদ ছাত্রলীগ করেছেন, জানি না। তাকে জাসদ করতে দেখিনি। এরপর তো তিনি মেডিক্যালে চলে গেলেন। সেখানে গিয়েই তো ছাত্র শিবিরের নেতা হয়ে গেলেন। আমি দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি, তিনি জাসদ ছাত্রলীগ করেননি। এমসি কলেজ ওই সময় রাজনৈতিক কারণে উত্তাল ছিল। ওই সময় তো কোনও অ্যাক্টিভিটিসে দেখিনি, কোনও মিছিলে দেখিনি। কুলাউড়ার ভাটারা এলাকায় তার গ্রামের বাড়ি।’
জামায়াতের সূত্রগুলো জানায়, জামায়াতে আসার পর ডা. শফিকুর রহমান সিলেট মহানগরীর আমীর, অবিভক্ত জেলা আমির এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের একটি মেডিক্যাল কলেজ ও শিশু হাসপাতালের মালিকদের একজন।
একাধিক সূত্রের দাবি, ডা. শফিকুর রহমান আমির হলে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদ এগিয়ে থাকবেন। সাংগঠনিকভাবে মিয়া গোলাম পরওয়ার দলীয়ভাবে এ পদের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হলেও বর্তমানে নায়েবে আমির হিসেবে থাকায় সাংগঠনিকভাবে নিচের পদে আসবেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে নির্বাহী কমিটির কোনও কোনও সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরকে সেক্রেটারি জেনারেল করার পক্ষে। গঠনতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করেই সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত করবেন নতুন আমির। এক্ষেত্রে কোনও জটিলতা তৈরি হলে মজলিসে শুরার সদস্যদের মতামত নেবেন নতুন আমির।
দলের পর্যবেক্ষক পর্যায়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, আমির নির্বাচনের ভোটে কারাগারে থাকা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও ভোট দিতে পারেন রুকনরা। তবে খুব বেশি ভোট তার বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন সদস্য বলেন, ‘কারাগারে থাকায় সাঈদী সম্ভাবনা এখন প্রায় নেই।’
উল্লেখ্য, মকবুল আহমাদ আমির হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন কমিটিতে সাঈদীকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় দলের ভেতরে ও সাঈদীর পরিবার থেকেও প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। পরে আবার তাকে নায়েবে আমির হিসেবে যুক্ত করা হয়।
আরও পড়ুন: বিদায় নিচ্ছেন মকবুল, জামায়াতের নতুন আমির হচ্ছেন কে