সাত-আট দফায় আসছে যৌথ ঘোষণা

আচরণ-বক্তব্যে সতর্ক থাকায় জোর বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের

সভা-সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ এসেছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে। পাশাপাশি প্রকাশ্যে আচার-আচরণ ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে কৌশলী অবস্থান গ্রহণের পক্ষেও মত এসেছে।

শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটির প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। একইসঙ্গে বিএনপির ১০ দাবি ও ২৭ দফা প্রস্তাব এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে নতুন করে যুগপতের যৌথ ভিত্তি প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে বৈঠকে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্তত চার জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিগগিরই বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য জোটের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি যৌথ রূপরেখা ঘোষণা হবে। ইতোমধ্যে এই ভিত্তির হোমওয়ার্ক করা হয়েছে। সাত-আট দফার মধ্যে আসন্ন এই দাবিগুলো যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলেও জানান নেতারা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানান, ‘শিগগিরই এই ভিত্তির ঘোষণা আসবে।’

শুক্রবার বিকাল সোয়া ৪টায় দুই লিয়াঁজো কমিটির সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও নুরুল হক নুর অংশগ্রহণ করেন। বিএনপির মির্জা ফখরুলসহ ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বরকতউল্লাহ বুলু ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল অংশ নেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া এক প্রভাবশালী নেতা জানান, পুরো বৈঠকে চলমান আন্দোলনের পর্যালোচনা করা হয়। যুগপৎ হিসেবে যে প্রোগ্রামগুলো হয়েছে, সেসব রিভিউ করা হয়েছে। বৈঠকে নেতারা জানিয়েছেন, তারা মনে করেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এই আগ্রহকে আরও বেগবান ও বিস্তৃত করে সমাজের নানা অংশের মানুষের যুক্ততা প্রয়োজন মনে করছেন নেতারা।

গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা উল্লেখ করেছেন, অপরাপর দলগুলোও যেন আন্দোলনে যুক্ত হয়। ছাত্র, যুব ও শিক্ষকসহ সমাজের প্রতিটি পেশার লোকজনকে যুক্ত করতে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষে মত দেন উভয় পক্ষের নেতারা।

বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বৈঠকের একটি বড় অংশে চলমান যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এমন প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। বৈঠকে আলোচনায় এসেছে, কিছু নেতার অযাচিত বক্তব্য প্রদান, শারীরিক ভাষা নির্বাচনের পদ্ধতির কারণে আন্দোলন নিয়ে সরকার সুবিধা পাচ্ছে। এক্ষেত্রে বক্তব্য প্রদান, আচার আচরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকার আলোচনা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘এসব সরকারের প্রোপাগান্ডা। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া অনেক মজবুত। যুগপৎ আন্দোলনে আছি, আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘আমরা মনে করি সরকার নানাভাবে উসকানি দিয়ে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করতে মরিয়া। সরকারের মূল্য লক্ষ্য আন্দোলনে অনৈক্য সৃষ্টি করা। সে কারণে আন্দোলনে ঐক্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার যেন নষ্ট করতে না পারে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে, সে কারণে আলোচনা, বক্তব্যে বাক্য, শব্দ চয়নেও সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন নেতারা।’

সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

এ প্রসঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার এবং সরকারি এজেন্টরা স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নস্যাৎ করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করবে। তারা বিভিন্ন রকম গল্প তৈরি করবে। আমাদের মাথায় এসব নেই।’

বৈঠকসূত্র জানায়, শুক্রবারের বৈঠকে আন্দোলনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হলেও তা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া আন্দোলনে ঢাকার নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে যা যা করণীয়, তা নির্ধারণ করতে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৪ তারিখে আমাদের যুগপৎ কর্মসূচি আছে। ওই কর্মসূচির আগে আবারও লিয়াজোঁ কমিটি বৈঠকে বসবে। বৈঠকে চলমান পরিস্থিতি, যুগপৎ আন্দোলনকে আরও বেগবান করার বিষয়ে নানামাত্রিক আলোচনা হয়েছে। সাধারণ মানুষ চায় বিরোধী দলগুলো শক্তভাবে রাজপথে কর্মসূচি দিক।’

বৈঠকের পর যা বললেন মির্জা ফখরুল ও মান্না

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে পূর্বে যেসব কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, সেই কর্মসূচি নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। পরবর্তী কর্মসূচি কী হতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা করেছি। যারা যুগপৎ আন্দোলনে আছেন, ৪ ফেব্রুয়ারির পর কী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তা আলোচনা করা হবে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বৈঠকে চলমান আন্দোলনে শহীদ কর্মীদের স্মরণ করা হয়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বৈঠক শুরু হয়।’

গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়কারী মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এটা একটা নিয়মিত বৈঠক ছিল। কিন্তু প্রথমবারের মতো আ স ম আব্দুর রব ও মির্জা ফখরুল ছিলেন বৈঠকে। যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। যেসব কর্মসূচি চলছে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে আরও কর্মসূচি আসবে। এই কর্মসূচিকে সামনে নিয়ে যেতে চাই, ধীরে ধীরে সেটাকে বিজয়ের দিকে নিতে চাই।’

আলোচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো সামনে এনে মান্না বলেন, ‘ঐক্যটাকে আরও দৃঢ় করা। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ঢাকা মহানগরে যেন তৎপরতা বাড়ানো যায়। ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে মহানগরে। ৪ তারিখের পর আরও সম্মিলিতভাবে পরবর্তী ধাপে নিতে পারি, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ঐক্যকে দৃঢ় করার পাশাপাশি ঐক্যে যেন ফাটল না ধরে সে জন্য আলোচনা হয়েছে, সামনের দিকে আন্দোলনকে অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাওয়াই মূল উদ্দেশ্য।’