ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’তে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর দেওয়া ‘বিএনপি ধর্মনিরপেক্ষ দল এবং রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের পক্ষে নয় ও জামায়াত’ শীর্ষক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির সিনিয়র কয়েকজন নেতার মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত প্রগতিশীল দলগুলোতেও এ বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘রাজনৈতিক আদর্শ ও কৌশলকে’ কেন্দ্র করে বিএনপির মধ্যে নীতিগত যে পরিবর্তন এসেছিল এবং যারা দলের নীতিকে ‘দক্ষিণপন্থা’র প্রভাব থেকে বের করে নিতে চেয়েছেন, তাদের এই চেষ্টা দলের ভেতরে আবারও বাধার মুখে পড়লো।
দলের প্রভাবশালী ও একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জানান, মূলত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে ‘দলীয় বিবৃতির বিষয়ে’ সম্মতি আদায়ে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন স্থায়ী কমিটির দুই জন ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান। ‘সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো সক্রিয় থাকায় ইকবাল হাসান মাহমুদের বক্তব্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে বিবৃতি আদায় করা হয়েছে।
বুধবার (৭ নভেম্বর) ‘দ্য হিন্দু’তে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল এবং আমরা ‘ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারে’ বিশ্বাস করি না। জামায়াতের সঙ্গে সেই জোট এখন অতীত। শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন, তার জবাব দেওয়া উচিত, তিনি এত বছর ক্ষমতায় থাকতেও কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেননি।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ইসলামপন্থিদের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইকবাল হাসানের বক্তব্যের পর শনিবার (১১ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘‘সম্প্রতি ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’-তে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সেক্যুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা), পলিটিক্যাল ইসলাম (রাজনৈতিক ইসলাম) সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কিত যে মতামত প্রদান করেছেন, সেসব বক্তব্য এবং মতামত একান্তই তার নিজস্ব। এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।”
এই সদস্য আরও বলেন, ‘বিগত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তিনি বিদেশে থাকলেও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। এ অবস্থায় দলের বিবৃতি তাকে অপমানিত করেছে। হতাশাগ্রস্ত করেছে। বিশেষত, বিগত কিছু দিন আগে ভারতে অবস্থান করে বেশ কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে বৈঠক, আলোচনার পর দ্য হিন্দুতে সাক্ষাৎকার দেন ইকবাল হাসান মাহমুদ।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম একজন নেতা মনে করেন, ‘আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইকবাল হাসানের বক্তব্য ‘জাস্টিফাই’ না করে বরং ব্যাখ্যা দিতে পারতো বিএনপি। সেক্ষেত্রে আন্দোলনরত ধর্মভিত্তিক দলগুলো আমলে নিতো। এখন পুরো বিষয়টির দায়ভার তার ওপর বর্তিয়ে দল রিট্রিট করেছে। একইসঙ্গে তিনি সিনিয়র নেতা ও দলের এখন লিয়াজোঁ কমিটির দায়িত্বেও রয়েছেন। ফলে, তার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়াই ইতিবাচক হতো।’
রবিবার (১২ নভেম্বর) সকালে মঞ্চের এই নেতা আরও বলেন, ‘দলের নীতিনির্ধারণী বিষয় আবারও ‘দক্ষিণপন্থিদের হাতে গেলে কোনও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বিএনপি, ব্যর্থ চেষ্টা হবে।’
এ বিষয়ে মঞ্চের অন্যতম নেতা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের মতামত হচ্ছে, ‘বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। দীর্ঘদিন সেই নীতি অনুসরণ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভোটে জিতে মানুষের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় গেছে কয়েকবার। কিন্তু মাঝখানে (২০০০-২০০১) বিএনপি এই জায়গা থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমীকরণে সরে গিয়েছিল। তাতে সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিএনপি জাতীয়তাবাদী, উদার গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়নি। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আবার বিএনপি তাদের সেই পুরোনো ধারায় ফিরে যাচ্ছে। যে কারণেই দেশপ্রেমিক, উদার, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে।’
‘এবারের আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বিএনপির সেই পুরোনো সমীকরণ কৃত্রিম খোলস থেকে বেরিয়ে ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরেছে। এটাই মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে’ উল্লেখ করে সাইফুল হক বলেন, ‘৩১ দফায় গোটা রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এজেন্ডা এবারের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। বিএনপির অভিজ্ঞতা, একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা মিলিয়ে মানুষ আগ্রহ নিয়ে বিএনপির কৌশল গ্রহণ করেছে। ক্ষমতার দেশি-বিদেশি স্টেকহোল্ডাররাও ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। এই রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন ধারার, মানে ধর্মভিত্তিক বা বাম ধারার দলগুলোর আদর্শের কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় সবার জন্য গণতান্ত্রিক স্পেস তৈরি করেছে।’
সাইফুল হক বলছিলেন, ‘যেভাবে এক্সট্রিম রাইট উইং থেকে সেন্টার রাইটে ফিরেছে বিএনপি, দেশপ্রেমিক-প্রগ্রেসিভ শক্তির পুনরুত্থান বলতে পারি, যা বিএনপিকে জনপ্রিয় করেছে। বহুদিন ধরে বিএনপিকে এ ধরনের একটি ভূমিকায় দেখতে চেয়েছি। সেখান থেকে ভিন্ন দিকে ঝুঁকে গেলে তা বিপদের কারণ হতে পারে।’
বিএনপির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত একজন লেখক এ প্রতিবেদককে জানান, ইকবাল হাসান মাহমুদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় বিবৃতি আসায় বিরোধী দলগুলোর অনেকেই বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দলের একাধিক স্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইকবাল হাসান মাহমুদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দলীয় বক্তব্যের পর বহু নেতা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনুসারী কোনও কোনও নেতাকে তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়েছেন। তিনি দলের কাছে এটি আশা করেননি।
স্থায়ী কমিটির সূত্র জানায়, পুরো বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং শীর্ষ নেতৃত্ব বিব্রত রয়েছেন। ইতোমধ্যে এ রিপোর্ট লেখার সময় (১২ নভেম্বর দুপুর ১টা) পর্যন্ত ইকবাল হাসান মাহমুদের সঙ্গে তারেক রহমানের কোনও যোগাযোগ হয়নি। কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য যোগাযোগ করলেও বিষয়টিতে টুকু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়। পাশাপাশি স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইকবাল হাসানের দূরত্ব তৈরি হওয়ায় বিষয়টি আরও দূর গড়াতে পারে।
দলের প্রভাবশালী একজন সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘ইকবাল হাসান মাহমুদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানোয় দলের মধ্যে অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও ব্যক্তিগতভাবে ইকবাল হাসান মাহমুদ কারও কারও ‘অপছন্দের’ বিষয়টিই প্রকাশ হয়েছে। বিশেষত, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতারের পর দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দূরত্ব প্রকাশ্য হওয়ার বিষয়টিও নার্ভাসনেসের পরিচয়।
দলের আরেক দায়িত্বশীল উল্লেখ করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি কখনও উচ্চারণ করেনি বিএনপি। সেক্ষেত্রে কারও কারও যুক্তিতে টুকুর সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত শব্দটি (ধর্মনিরপেক্ষ) বেমানান হয়েছে। দল চাইলে আরেকজন নেতার মাধ্যমে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু বিবৃতি দিয়ে বরং দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রকাশ্যে আনা হলো।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি উনার বক্তব্য পড়িনি। শুনেছি। তিনি তার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দূরত্ব হয়নি। আমরা আন্দোলনে আছি। আমাদের ধ্যান-জ্ঞান আন্দোলন। আমরা যেটা করতে চাই, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ। অন্য আর কোনও চিন্তা নেই।’
যদিও বিএনপির সিনিয়র নেতা সেলিমা রহমান তা নাকচ করে দেন। আলাপকালে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সবারই রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। জামায়াত করছে, ইসলামী আন্দোলন করছে। ২০০১ সালের মতো কেন মনে হবে। নির্বাচনি জোট এক জিনিস, নির্বাচনি সরকার চালানো এক জিনিস। আমরা এখন আন্দোলনকে সামনে রেখে চলছি। জামায়াতও একই পথে চলছে।’
বিএনপি ও বর্তমান রাজনীতি নিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এমন একজনের অভিমত, ‘বিএনপি কারও প্ররোচনায় সাময়িক পথভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু দিন শেষে এখানে হয় নিজের বুদ্ধিমত্তায় কিংবা নিরূপায় হয়ে ফিরে আসতে হবে। এর বিকল্প নেই। যেভাবেই যে হোক কিংবা যে কারণেই ফিরে আসুক, তাতে সুফল আসবে।’
ইকবাল হাসান মাহমুদের বক্তব্যের পর জামায়াত থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া বা চাপ দেওয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে দলটির একজন নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে কোনও প্রেসার দেওয়া হয়নি। ইসলামপন্থিরা ছাড়া এখন কে আছে বিএনপির সঙ্গে? এটা ভেবেই হয়তো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’
প্রসঙ্গত, নভেম্বর মাসের শুরুতে আজমির শরিফ সফরের উদ্দেশে ভারতে যান ইকবাল হাসান মাহমুদ। কলকাতায় তার দাদার কবর জিয়ারত করে দিল্লিতে যান তিনি। ভারতে অবস্থানকালে তিনি পুরোনো ব্যবসায়িক বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করেন। গত ৭ নভেম্বর তিনি দ্য হিন্দুতে সাক্ষাৎকার দেন। ৮ নভেম্বর তিনি ভারত ত্যাগ করেন।
বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। চিকিৎসার কারণে বিদেশে গেলেও আদালতের একটি রায়ে তার সাজা হয়েছে। বর্তমানে তিনি অনেকটাই নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। যে মামলাটিতে তার সাজা হয়েছে, তা মঈন-ফখরুদ্দিনের সময়কার।
এর আগে ভারতে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও বেশ কিছু দিন দিল্লিতে ছিলেন। তার পরিবারের ভাষ্য, তিনি সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
জামায়াত নিয়ে বক্তব্য দিয়ে দলের মধ্যে চাপে টুকু, রিজভীর বিবৃতি