তুর্কি সাংবাদিকের বিতর্কিত নিবন্ধ

‘জামায়াতে ইসলামী পশ্চিমের জন্যও হুমকি’

বাংলাদেশে শীর্ষ আদালতের আপিল বিভাগ যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের আদেশ বহাল রাখছে, তখন এই দলটি যে পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও কতটা ‘বিপজ্জনক’, সেই তত্ত্বকে সামনে রেখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছে।

বিশদ গবেষণার ভিত্তিতে এই নিবন্ধটি লিখেছেন তুরস্কের সাংবাদিক উজে বুলুত। আর তার এই লেখাটি প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক সুপরিচিত থিংকট্যাংক গেটস্টোন ইনস্টিটিউট।

কট্টর ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়ার জন্য গেটস্টোন ইনস্টিটিউট দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তথা প্রতিষ্ঠাতা হলেন নিনা রোসেনওয়াল্ড, যিনি দীর্ঘদিন ধরেই এই ইস্যুতে সরব। 

গেটস্টোন ইনস্টিটিউট উজে বুলুতের যে নিবন্ধটি গত ১৫ নভেম্বর (বুধবার) প্রকাশ করেছে, তার শিরোনাম হলো: সেক্যুলারিজম বনাম থিওক্রেসি: বাংলাদেশ এবং পশ্চিম যখন হুমকির মুখে!    

উজে বুলুত   

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তুরস্ক হলো এমন একটি দেশ, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর প্রতি যাদের সমর্থনের কথা সুবিদিত। একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারে বাংলাদেশে যখন একের পর এক শীর্ষ জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে– তুরস্ক সরকার শুধু তার তীব্র প্রতিবাদই জানায়নি, একটা পর্যায়ে ঢাকা থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকেও প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। 

অথচ সেই তুরস্কেরই সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও উজে বুলুত বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন–যা ইতোমধ্যে বেশ তর্কবিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

কিন্তু সেই নিবন্ধে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী নিয়ে ঠিক কী যুক্তি দিয়েছেন মিস বুলুত?

প্রথমত, তিনি বলছেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানেই সে দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছিল। এই ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মৌলিক নীতি এবং এ কারণেই সেখানে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ। অথচ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ঠিক সেটাই করছে– তারা ইসলামকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছে।

দ্বিতীয়ত, তিনি আরও দাবি করেছেন, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ও মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শ (আইডিওলজি) হুবহু একই রকম। এই দুই দলই নিজ নিজ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, যেখানে নিজস্ব সংবিধান নয়– কঠোর শরিয়াই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীদের অধিকারও সেখানে প্রবলভাবে সংকুচিত।

নিনা রোসেনওয়াল্ড

তৃতীয়ত, মুসলিম ব্রাদারহুডের মতোই বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীরও আদর্শগত উৎপত্তি ইসলামের তাত্ত্বিক নেতা আবুল আলা আল মওদুদীর চিন্তা ও দর্শন থেকে। আল মওদুদীর ভাবধারা নিয়ে বহুকাল ধরেই বহু বিতর্ক আছে, তবে ‘কোনও নারী রাষ্ট্রের প্রধান হতে পারবেন না’– তার এই বক্তব্যটি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে বললে, এই কথা মানতে গেলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্যন্ত অসম্ভব।  

বাংলাদেশে জামায়াতের যে উগ্রপন্থা (মিলিট্যান্সি) ও গণহত্যার (জিনোসাইড) একটা কলঙ্কিত ‘লিগ্যাসি’ (উত্তরাধিকার) আছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন উজে বুলুত।  

ফলে বাংলাদেশে জামায়াতের কর্মকাণ্ড কেন বন্ধ করা দরকার, এভাবেই ধাপে ধাপে তার আরও নানা যুক্তি পেশ করেছেন ওই সাংবাদিক। নিবন্ধে জামায়াতবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরতে তিনি মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বা রাইটস গ্রুপ ‘সাউথ এশিয়া ডেমোক্র্যাটিক ফোরাম’-এর বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে যেমন তথ্য আহরণ করেছেন, তেমনি উদ্ধৃত করেছেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাজনীতির অধ্যাপক আলী রিয়াজের রচনা থেকেও।

জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে গেটস্টোন ইনস্টিটিউটের পোস্ট

সবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী শুধু সেই দেশের জন্যই নয়– সমগ্র অঞ্চলের জন্যই একটি নিরাপত্তা হুমকি। এই ‘মৌলবাদী ইসলামপন্থি’রা রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলে তা সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, অস্থিতিশীলতা এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনকেই নিয়মে পরিণত করবে বলেও তিনি মনে করছেন। যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বেই।

ফলে পশ্চিমা দুনিয়াতেও ‘ফ্রিডম’ বা স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে জামায়াতের এই রাজনৈতিক আদর্শকে ‘কনফ্রন্ট’ (প্রতিহত করা) খুব জরুরি– এটাই উজে বুলুতের অভিমত।

গেটস্টোন ইনস্টিটিউট এই নিবন্ধটি প্রকাশ করার পর থেকেই তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল তর্কবিতর্কও শুরু হয়েছে যথারীতি।