২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা পরবর্তী সময়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখছে দলটি। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব বৈঠকেও তাদের অবস্থান অনেক পুরোনো রাজনৈতিক দলের চেয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে। বিশেষ করে বর্তমানে সামনের সারিতে থাকা প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের পরই তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভ্রাতৃপ্রতিম অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানেও একই গুরুত্ব পাচ্ছেন চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করা চার মাস বয়সী রাজনৈতিক দলটির নেতারা।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেয়ে বয়স ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনুজ হলেও নিজেদের সক্রিয় অবস্থানের কারণে জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর ফোকাসও তাদের দিকে। অনেক সময় তাদের ফেসবুক পোস্ট হয়ে যাচ্ছে সংবাদের প্রধান শিরোনাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা দেশে এলেও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করছেন।
রাজনৈতিক দলটির বয়স অল্প হলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছে। ইতোমধ্যে সারা দেশে ২৫৩টি সেল, উইং ও কমিটি গঠন সম্পন্ন করেছে। কয়েকটি এলাকায় শোডাউনও দিচ্ছে দলটির একাধিক নেতৃত্ব।
চাকরিতে ন্যায্য অধিকার পেতে আন্দোলনকারীদের সরাসরি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার চিন্তা কোথা থেকে এলো, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল গঠনের মতো এত বড় দুঃসাহসিক চিন্তা কোন প্রেক্ষাপটে করেছেন? কতটুকু আশাবাদী তারা? ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এনসিপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
আরিফুল ইসলাম আদিব
জুলাই আন্দোলনের সময় একটি জাতীয় গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন।
রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা কীভাবে? জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কোটার বিষয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান চেয়েছিলাম। শুরুতে রাজনীতির চিন্তা মাথায় ছিল না। তখন সরকার পতনও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তবে আমাদের ভাই বোনদের নির্বিচারে হত্যার পর থেকেই এ বিষয়ে এক দফায় যাই। আন্দোলন পরবর্তী বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল গঠন এবং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের রাজনীতিতে আসার পথরেখা তৈরি হয়।’
আদিব বলেন, ‘আমি ফ্রন্টলাইনে ছিলাম না। তবে গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে আন্দোলনের বিভিন্ন সংবাদ সরবরাহ করতাম। বিশেষ করে ইন্টারনেট বন্ধ থাকাকালীন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই নাহিদ ইসলামকে আটকের দিন আমাকে ইঙ্গিত করে কথা বলেছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কারণ সেদিন নাহিদের সঙ্গে আমার ৪৫ মিনিট কথা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ২৬ জুলাই আমার পত্রিকা অফিসে প্রবেশ করে আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে র্যাব। তিনবার গুম করতে চেয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন এনসিপির নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, গত ১০ বছরের বেশি সময় তারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গেও তাদের এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই পরিবারতান্ত্রিক। এতে শিক্ষিত তরুণদের নেতৃত্বে আসার তেমন সুযোগ ছিল না। শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে যায়, তখন আপামর জনসাধারণ ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তাদের আন্দোলনের স্পিরিট ধরে রাখার তাগিদ দিতে থাকে। আমাদের প্রতি দেশের মানুষেরও প্রত্যাশা তৈরি হয়। আমরাও মনে করি অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই মেধাবী ও চৌকস নেতৃত্বের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠন করা হয়েছে। আমি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ আশাবাদী।’
হাসনাত আব্দুল্লাহ
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘১৬ জুলাইয়ের আগে আমরা কোটা সংস্কারের জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। আমাদের এমন পরিকল্পনা ছিল না যে সরকার পতন হবে, আর আমরা রাজনীতিতে আসবো। কোটার যে ন্যায্য সংস্কার সেটাই আমরা চেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘১৬ জুলাইয়ের পর ব্যাপারটা একটু চেঞ্জ হয়েছে। তখন আমাদের ভাইদের গুলি করে মারা হয়েছে, জেলে ঢোকানো হয়েছে। আবু সাঈদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এরপর আমাদের দিয়ে জোর করে নাটক করানো হয় যে আন্দোলন বন্ধ করা হয়েছে। মূলত এভাবেই আমাদের জুলাই মাস গিয়েছে। এর মাঝে আমাদের প্রথমে ডিজিএফআই দুই দিন আটকে রাখে। পরে ক্যান্টনমেন্টে দুই দিন রাখা হয়। সেখান থেকে ছেড়ে দিলে পরে আবার ডিবি ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আন্দোলন বন্ধের মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া না হলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ের সমন্বয়ই আসলে আন্দোলনটাকে এক দফায় নিতে জোরালো ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এলো এক দফা। এক দফার পর আসলে আর পথই খোলা ছিল না আমাদের কাছে। অনেকগুলো দায়িত্ব এসে পড়লো কাঁধে।’
রাজনীতিতে আসার কারণ সম্পর্কে হাসনাত বলেন, ‘এক দফার পর রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা দায়িত্ব এসে পড়ে আমাদের ওপর। সেখান থেকেই প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হই। পরবর্তীতে এনসিপিতে আসি। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ছিল। কিন্তু সেখান থেকে আমরা কিছু করতে পারছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু রাজনৈতিক সংস্কারের কথা আমরা বলছি, সেক্ষেত্রে আমরা যদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হই, তাহলে রাজনৈতিক কার্যক্রমে আমাদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক হবে না। রাজনৈতিক সংস্কার, নির্বাচনি সংস্কার, সংবিধান সংস্কার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান দরকার ছিল। এই শূন্যতা পূরণ করার জন্যই রাজনীতিতে আসা। কারণ তখন প্রেসার গ্রুপ হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই ঘোষণাপত্রের কথাও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এখন আমরা রাজনৈতিক দল, আমাদের কথা বলার জায়গা আছে।’
মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্দোলনের শুরু থেকেই তো আর সরকার পতনের কথা ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম কোটার সংস্কার হোক। একটা দেশে অর্ধেকেরও বেশি চাকরি কোটায় হবে এভাবে তো চলতে পারে না। তখন আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্র-জনতার উপস্থিতি নিশ্চিত করে বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজীবনের জন্য কোটার সংস্কার করা। এরপর ১৬ জুলাই থেকে যখন মানুষ মারা শুরু করলো তখন দেওয়া হলো আমাদের চার দফা। চার দফা নিয়েই আন্দোলন চললো বেশ কিছু দিন।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে আন্দোলন চলছিল অন্যদিকে তারা মানুষ মারছিল, গ্রেফতার করছিল গণহারে। নাহিদ-আসিফসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পরে এলো ৯ দফা। এরপর এসেছে কাঙ্ক্ষিত এক দফা। চার দফাকে এক দফা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে।’
রাজনীতিতে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটিতে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ছিলাম। কিন্তু আমরা অনুধাবন করি যে সেখান থেকে সংস্কার সম্ভব না। আমরা দেশে সুন্দর গণতন্ত্র দেখতে চাই। জুলাইয়ের যে স্লোগান- দেশটা কারও বাপের না, এ দেশ দেশের জনগণের। তার জন্য জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই সংস্কারগুলো আমরা রাজনৈতিক দল না হলে করতে পারবো না। এ দেশকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে আর কোনও ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিতে না পারে।’
মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক আরও বলেন, ‘দেশটি এখন তারেক রহমানের বাপেরও না, নাহিদ ইসলামের বাপেরও না। আর সেজন্য এ দেশের বিচার বিভাগ, সংবিধান, নির্বাচনি নীতিমালা সব কিছু সংস্কার করতে হবে। এ জন্যই আমরা রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছি।’
সাইফ মোস্তাফিজ
আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে আসার বিষয়টি কীভাবে এলো জানতে চাইলে এনসিপির আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব সাইফ মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমরা তো ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছি। ১৮-এর কোটা সংস্কার ও পরবর্তীতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে আমাদের আন্দোলনের বড় জায়গায় পদার্পণ। পরবর্তী সময়ে কিন্তু আমরা এক হয়েছিলাম। কথা বলতাম ও মাঠে নামতাম। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনীতি করে জীবন চালানো কঠিন। সে জায়গা থেকে আমরা অনেকেই নিজেদের পেশাগত কাজেও মনোনিবেশ করেছি। কারণ আয়ের উৎস না থাকলে আমাদের অনৈতিকতার দিকে ধাবিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। তবে আমাদের সব সময় ইচ্ছা ছিল দেশের জন্য কিছু করার। সে কারণেই রাজনীতি চর্চা করতাম।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় চোখের সামনে অসংখ্য মানুষকে মারা যেতে দেখেছি। সেই জায়গা থেকে নিজেদের জীবনকে বোনাস মনে করছি। তাই আমাদের মনে হয়েছে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং শহীদ ও আহতদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে যারা জীবন বাজি রেখে ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন, তাদের জন্য হলেও আমাদের রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’
এনসিপির এই নেতা আরও বলেন, ‘গত বছরই আমার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেই সুযোগ বাদ দিয়ে দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই রাজনীতিতে আসা। এক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন আনতে চাই। স্বপ্ন দেখছি এখানে হয়তো কিছু করা সম্ভব। সবাই মিলে সেই চেষ্টাই করছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে আমরা কোনোভাবেই বিফল হতে দিতে চাই না।’