ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন বিধিমালা বাস্তবায়নের দাবি

ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ উল্লেখ করে এ সংক্রান্ত বিধিমালাটি দ্রুত প্রয়োগের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। ‘বাংলাদেশের টেকসই পরিবেশ ও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: সমস্যা এবং সমাধান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ দাবি জানান।

বুধবার (৩০ জুন) গবেষণা সংস্থা ভয়েসেস ফর ইন্টারেক্টিভ চয়েস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট (ভয়েস) এক আলোচনা সভাটির আয়োজন করে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খালিকুজ্জামান আহমদ।

অনুষ্ঠানে প্যানেলে আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) সাধারণ সম্পাদক ড. শাহরিয়ার হোসেন, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জিয়াউল হক, প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল প্রমুখ। ভয়েসের সিভিক সেন্টার থেকে ভার্চুয়াল এই সভাটির সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ। অনুষ্ঠানে এনজিওকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, সাংবাদিক, নারীনেত্রীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

ভয়েসের প্রোগ্রাম অফিসার আফতাব খান শাওন মূল বক্তব্য উপস্থাপনে বলেন, ২০১৮ সালে দেশে ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে মাথাপিছু ৯০০ গ্রাম। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যা এশিয়ার অনেক গুলো দেশের চেয়ে বেশি। ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশে বছরে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন মানবদেহের জন্য মারাত্মক ওই সব ই-বর্জ্য তৈরি হবে। বাংলাদেশে বছরে ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে ইলেকট্রিক সামগ্রি বিক্রি হয়। যার যার ৪০ শতাংশ রেফ্রিজারেটর ও ৩০ শতাংশ টেলিভিশন। তবে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রিক সামগ্রি হচ্ছে মোবাইল ফোন। এর মধ্যে মোবাইল ফোনের অর্ধেক ভোক্তা প্রায় প্রতি বছর একাধিক মোবাইল সেট কেনেন এবং একটি ফেলে দেন।

ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালাটির যুগোপযোগিতা বাড়ানো এবং তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। এছাড়া দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি ইলেকট্রনিক বর্জ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে, তার জন্য সরকারি উদ্যোগে গবেষণা প্রয়োজন।

পিকেএসএফ এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খালিকুজ্জামান আহমদ বলেন যে, সকল মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দেশে একটি পরিবেশবান্ধব ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, সম্ভব হলে প্রতিটি জেলাশহরে বিশেষ অঞ্চল গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিধিমালা বাস্তবায়নের স্বার্থে পরিবেশসম্মত ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং প্লান্ট গড়ে তোলা আবশ্যক এবং এক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ নজর দিতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর এর পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, নতুন বিধিমালা অনুযায়ী কাজ করলে এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ই-বর্জ্রের ক্ষতি থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিধিমালার ধারা ১৫-তে উল্লেখ আছে, কোনও পুরাতন বা ব্যবহৃত ইলকেট্রক্যিাল এবং ইলকেট্রনকি পণ্য আমদানি করা অথবা দান, অনুদান বা অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করা যাইবে না এবং ধারা ৯ এর ‘পুনঃপ্রক্রয়িাজাতকারীর দায়িত্ব’ এর পরিপূর্ন প্রয়োগ আমাদের পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা করতে পারবে। এছাড়াও বিধিমালায় প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

ইএসডিও-এর সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ইলেকট্রনিক বর্জ্যের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতিটা হচ্ছে তা স্থায়ী এবং এর প্রভাব মারাত্মক। তাই এ-সম্পর্কিত আইনি বাধ্যবাধকতা থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। তিনি ই-বর্জ্যকে ‘স্লো পয়জন’ এর সাথে তুলনা করে সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বাজেট কমেছে এবং অন্যদিকে জেলা শহরে ব্যাটারি চালিত গাড়ির পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের দেশে যদি ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তাহলে তা হতে পারে মূল্যবান সম্পদ। বিদেশে ভালো চাহিদা থাকায় রাজধানীর অনেক ভাঙারির দোকানে আলাদা করা হচ্ছে নষ্ট ইলেক্ট্রনিক পণ্যের মূল্যবান যন্ত্রাংশ।

প্রথম আলোর পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ বলেন, প্রতি বছর মোট আমদানিকৃত ই-পণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। একটু চিন্তা করলেই এর ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ও ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাই উন্নয়নশীল বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রাখতে সঠিক ও কার্যকর ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া উচিত।

আলোচকগণ ই-বর্জ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি, যথার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, এবং ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের আহ্বান জানান। এ লক্ষ্যে ই-বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কথা বলেন বক্তারা। সঠিকভাবে বিধিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আহ্বান জানানো হয়।