১৭ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বকাপ জয়, তিনটি বিশ্বকাপ আর সব খেলা মিলিয়ে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮১ গোল ফুটবলের যথার্থই সম্রাট রূপে পেলেকে দাঁড় করায়। যেখানে কোন অনাগতকালে দ্বিতীয় কেউ তার পাশে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না।
ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিনাস জেরাইসের ত্রেস কোরাকোয়েস নামের শহরে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটির আজ ৮০ বছর বয়স হলো। ত্রেস কোরাকোয়েস থেকে সাওপাওলো, সাওপাওলো থেকে সান্তোস, সান্তোস থেকে সারা পৃথিবীতে ফুটবলের মুগ্ধতা বুনে তিনি পৌঁছে গেছেন জীবন সায়াহ্নে। তবে জীবনের শেষবেলায় পৌঁছে যাওয়ার কথা তাকে বলতে যাবেন না। তার কাছে বয়স একটা সংখ্যা। প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি জীবনের উচ্ছলতায় টগবগে থাকতে চান। কয়েক বছর ধরেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। পত্রিকান্তরে খবর, ৮০তম জন্ম বার্ষিকীর সপ্তাহ খানেক আগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ) তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলো। অনলাইনে রসিক পেলের উত্তর, ‘আমি খুব ভালো আছি, শুধু ফুটবলটাই খেলতে পারবো না মাঠে গিয়ে।’
এসব কারণে নয়, তার জন্মদিনটিকে নির্জনতায় ঢেকে দিয়েছে করোনাভাইরাস। দীর্ঘসময়ের মুখপাত্র পেপিতোস ফরনোস বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, সাওপাওলোর সৈকত শহর গুয়ারুহার সমুদ্রতীরবর্তী বাড়িতে কাটবে তার অনাড়ম্বর জন্মদিন। কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকেই এই বাড়িতে আছেন। সান্তোস বা সাওপাওলোর বাড়িতে এর মধ্যে যাওয়াই হয়ে ওঠেনি।
কোডিভ-১৯ মহামারি এখন একটা যৌক্তিক কারণ, তিনবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) এমনিতেই কখনও জন্মদিন সাড়ম্বরে উদযাপন করতে চাননি। এবারের জন্মদিন অনাড়ম্বর হওয়ার আরেকটি কারণ, ফরনোস যেমনটি বলেছেন, মার্চ মাসে ক্যানসার আক্রান্ত ভাই জেয়ারের মৃত্যুশোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি পেলে।
পেলের ৮০তম জন্ম বার্ষিকী মিলে গেছে ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ের ৫০তম বার্ষিকীর সঙ্গে। উদযাপন শুরু হয়েছে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে, সেদিনই তার শরীরের আকৃতির সমান ভাস্কর্য অবমুক্ত হয় রিওর বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে। কিন্তু তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি।
তবে এমন এক জন্মদিনে ব্রাজিল কিছু শ্রদ্ধার্ঘ্য না রেখে পারেই না। সাওপাওলোর ফুটবল জাদুঘরে তার একটা ম্যুরালের উদ্বোধন হবে, যেটির নকশাকার সান্তোসের বিখ্যাত পথশিল্পী কোবরা। সেখানেই এই ম্যুরাল হচ্ছে, যেখানে ১৫ বছরের বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে শুরু হয়েছিল তার পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার।
মেক্সিকোর গ্র্যামি বিজয়ী শিল্পী জুটি রদ্রিগো ও গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে একটি গানও রেকর্ড করা হয়েছে তার। যেটিকে তিনি বলেছেন নিজের ও ভক্তদের জন্য ‘জন্মদিনের সামান্য উপহার’।
বুধবার তার ১২৮১টি গোলের একটির উদযাপনের ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে পেলে লিখেছেন, ‘ব্রাজিল ও ব্রাজিলিয়ানদের ধন্যবাদ। সবসময় এই জার্সিটা ভালোবেসেই গায়ে তুলেছি আমি। আমার জন্মদিনে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানানোয় সবাইকে ধন্যবাদ।’
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের সাদা-কালো জার্সিতেই হোক অথবা কালার টিভির যুগে হলুদ-সবুজ ১০ নম্বর জার্সিতে, এরকম অজস্র গোলের উদযাপন তার অসাধারণ ফুটবল নৈপুন্যের স্মারক। যা উত্তরকালে ‘জোগো বোনিতো’ বা সুন্দর ফুটবলের সংজ্ঞা হয়ে মিশে গেছে ব্রাজিলের ফুটবলে।
বিশ্ব ফুটবলে তার ছায়াটা এতই দীর্ঘ যে ফিফা ২০০০ সালে আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে যৌথভাবে তাকে সম্মাননা জানিয়েছে শতাব্দী সেরা ফুটবলার হিসেবে। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশেনগুলোর সদস্যদের ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়েছিলেন পেলে। আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতানো ম্যারাডোনা বেশি ভোট পান অনলাইনের নির্বাচনে। এ মাসেরই ৩০ তারিখে ম্যারাডোনার জন্মদিন, পা দেবেন ৬০ বছরে।
এ বছরের শুরুর দিকে তার ছেলে এডিনিয়ো বলেছিলেন, স্বাস্থ্যগত সমস্যাই বিষন্ন করে তুলেছে পেলেকে, ‘শুধু একবার ভাবুন, তিনি হলেন সম্রাট, সবসময়ই তিনি অমনটা থাকতে চান, কিন্তু এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না।’ তবে ছেলের কথায় পাত্তা না দিয়ে পেলে দ্রুতই ভক্তদের আশ্বস্ত করেন যে তিনি ভালো আছেন, ‘বেশিরভাগ দিনই ভালো কাটছে আমার, কিছু কিছু দিন হয়তো একটু কম ভালো। তবে আমার বয়সী একজন মানুষের জন্য এটা তো স্বাভাবিক।’
গত মঙ্গলবার তিনবারের বিশ্বকাপজয়ী সংবাদমাধ্যমে একটি ভিডিও পাঠিয়ে বলেছেন, মানসিকভাবে ভালো আছেন। গলায় রসিকতার সুর, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এতটা পথ সজ্ঞানে পেরিয়ে আসার স্বাস্থ্য তিনি আমাকে দিয়েছেন। খুব বুদ্ধিদীপ্তভাবে এগিয়ে আসার মতো করে নয়, তবে সজ্ঞানে অবশ্যই।’
‘আমার আশা, মৃত্যুর সময় ঈশ্বর আমাকে সেভাবেই স্বাগত জানাবেন, যেভাবে সারাবিশ্ব আমাদের প্রিয় ফুটবলের কারণে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে’-আরও যোগ করেছেন পেলে।
৮০তম জন্মবার্ষিকীতে পেলে হয়তো নিজেকে নিয়ে স্বভাবসুলভ রসিকতাই করেছেন। তবে এটাও ঠিক, অন্যলোকে ফুটবল বলে যদি কোনও খেলা থাকে, ঈশ্বর তাকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানাতেই দাঁড়িয়ে থাকবেন প্রবেশ দুয়ারে।