চার বছর পেরিয়ে বাংলা ট্রিবিউন

‘আড্ডা আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন’

ৃুাৃমাশরাফি বিন মুর্তজা নিজেই এক ‘ইতিহাস’। তার জাদুকরী স্পর্শে বদলে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।  মাঠের ভেতরে তিনি দৃঢ়চেতা অধিনায়ক, আর মাঠের বাইরে বর্ণিল চরিত্রের অধিকারী। মাশরাফির জীবনের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে যে কেউ। বাংলাদেশের সফল অধিনায়কের ছেলেবেলা কেটেছে দস্যিপনায়। স্কুল পালিয়ে চিত্রা নদীতে সাঁতার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কেটে যেতো সময়। আজও আড্ডাই তার প্রাণ, এখনও বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডায় মেতে ওঠেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। সাংবাদিকদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক মাশরাফির। বাংলা ট্রিবিউনের চতুর্থ বর্ষপূর্তির কয়েক দিন আগে নিজের বাসায় দীর্ঘ আলাপচারিতায় অনেক কথাই বললেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবন আর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে না বলা কথার পাশাপাশি ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়েও সুচিন্তিত মতামত দিলেন।

আপনার কাছে জীবনের সংজ্ঞা কী?

আমার কাছে জীবন মানে সংগ্রাম-স্বপ্ন-হাসি-আনন্দ। জীবনকে সুন্দর করতে হলে প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবে-চিন্তে নিতে হবে, ন্যায়-অন্যায় এবং নৈতিকতার প্রশ্ন সামনে এনে ভাবতে হবে।  জীবন যেহেতু একটাই, তাই জীবনকে সুন্দরভাবে চালাতে সক্ষম ব্যক্তিকে আমরা সফল বলি। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এমন ভাবে চলা, এমন কিছু করা যেন মানুষের মনে আজীবন বেঁচে থাকা যায়। একজন মানুষকে জীবনে চলার পথে এমন কিছু করতে হবে, যাতে অন্যরা তাকে পছন্দ করে, মনে রাখে। আমার চোখে জীবন মানে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলা, কারও সঙ্গে ঝামেলা না বাঁধিয়ে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে বেঁচে থাকা। সব রকম পরিস্থিতির সঙ্গে যে ব্যক্তি মানিয়ে নিতে পারবেন, তিনিই উপভোগ্য জীবন যাপন করতে পারবেন।  

বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনি একজন আইকন। নিজের জনপ্রিয়তা নিয়ে আপনার কী মতামত?  

এটা আমি কীভাবে বলবো (হাসি)। চেষ্টা করি স্বাভাবিক থাকার। একটা জিনিস সব সময় মেনে চলি, আমাকে যারা ভালো জানেন, তাদের যেন কখনও আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা না হয়। ভালো থেকে খারাপ হতে তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে! আমি যেহেতু মানুষ, তাই আমারও  ভুল হতে পারে। আমি শুধু সেটাই করি, যেটাতে আমার মন সায় দেয়। মানুষের কাছ থেকে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। ভালোবাসার প্রতিদান দিতে না পারলেও মানুষের চোখে যেন নিচু হয়ে না যাই। তবে সবচেয়ে বড় কথা, আমি জনপ্রিয়তা নিয়ে ভাবি না। জনপ্রিয়তার কথা আমার মাথায় আসে না।

আপনার মেন্টর কে?

আমার কোনও মেন্টর নেই, আমি কারও কথায় সিদ্ধান্ত নেই না। অনেকেই  পরামর্শ দেন, তখন তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা  আমি নিজেই নেই। ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই জীবন পার করছি। এমন নয় যে আমার সব সিদ্ধান্ত ঠিক। তবে নিজের সিদ্ধান্তে মানসিক তৃপ্তি থাকে।

জীবন নিয়ে আপনার কোনও আক্ষেপ আছে?

আক্ষেপ করার মতো কিছু নেই। নিজের জীবন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা মন চেয়েছে, সেটাই করেছি। বন্ধু আর পরিবার নিয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছি। ক্রিকেট না খেললে হয়তো পরিবারকে আরও বেশি সময় দিতে পারতাম। কিন্তু পরিবার যে বঞ্চিত হয়েছে সেটাও  নয়।

যদি ক্রিকেটার না হতেন?

ক্রিকেটার না হলে জীবনটাই অন্যরকম হতো।  আব্বা চেয়েছিলেন আমি যেন গান গাই। মা-ও  চাইতেন,  তাই গানের শিক্ষক রেখেছিলেন। আমি কান্নাকাটি করে গান শেখা বাদ দিয়েছি। পড়াশোনাতেও আমার মন ছিল না। চাপিয়ে দিয়ে যে কোনও জিনিস হয় না, আমি নিজেই তার প্রমাণ। আমার ভেতরে ছিল খেলাধুলা আর আড্ডাবাজি। এ দুটো না থাকলে ঢাকায় আসা হতো না, মাশরাফি হয়ে উঠতে পারতাম না।  হয়তো নড়াইলের কৌশিক হয়ে বেঁচে থাকতাম।

ুৃািৃআপনি আড্ডাপ্রিয় মানুষ। এই মুহূর্তে যদি বলা হয়, আপনার আড্ডা বন্ধ..

সত্যি কথা বলতে, আড্ডা বন্ধ হলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে আমার জন্য। আড্ডাই আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। স্ত্রী, ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে ড্রইং রুমে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেই। যত কাজই থাকুক, আমাকে আড্ডা দিতেই হবে। এটা আমার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকটা অক্সিজেনের মতো। আড্ডা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য বলতে পারেন। আমি এবং আমার স্ত্রী সুমি যৌথ পরিবার থেকে এসেছি। সেজন্যই হয়তো আমরা দুজনই আড্ডা দিতে ভালোবাসি।

জীবনের পথ চলায় আপনার স্ত্রীর অবদান কতখানি?

পুরো সংসার তো সুমিই সামলায়। সবচেয়ে বড় সুবিধা, খেলা নিয়ে তার তেমন আগ্রহ নেই।  সারাক্ষণ সংসার আর বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ২০০৬ সালে বিয়ে হয়েছে আমাদের, মানে এক যুগের দাম্পত্য জীবন। আমাদের সম্পর্ক সব সময়ই মজবুত। তবে প্রথম সন্তান হওয়ার পর আমাদের বোঝাপড়া আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় আমি সুমির কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেওছি।

স্ত্রীর কোন বিশেষ গুণের কথা আপনি সবার আগে বলবেন?

সুমি মানসিকভাবে অনেক শক্ত। প্রথম সন্তান হওয়ার সময় ডাক্তার ওকে বলেছিল, আপনার সন্তান বাঁচবে, তবে আপনাকে হয়তো বাঁচাতে পারবো না! এমন ভয়ঙ্কর কথা শোনার পরও সে স্বাভাবিক ছিল। আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিল যেন সব কিছুই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবে অপারেশন থিয়েটারে গেছে,  শারীরিক অবস্থা  জানতে চেয়েছে। ওর এমন মনের জোর আমাকে বিস্মিত করেছে। সুমির কাছ থেকে আমি শিখেছি, কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়েও কীভাবে স্বাভাবিক থাকা যায়।  অনেকেই বলেন আমি মানসিকভাবে শক্তিশালী। কিন্তু সুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

বাবা হিসেবে ছেলে-মেয়েকে কোথায় দেখতে চান?

সন্তানদের ওপর কোনও কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। কারণ চাপিয়ে দিয়ে যে কিছু হয় না, আমি নিজেই তার বড় উদাহরণ। তবে আমার একটা ইচ্ছের কথা বলতে পারি। বড় হয়ে আমার মেয়ে হুমায়রা ডাক্তার হলে খুব খুশি হবো। আমি চাই ও যেন মানুষের সেবা করতে পারে। আর ডাক্তারদেরই মানুষের সেবা করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। অবশ্য মেয়ে যা হতে চাইবে, সেটাই আমি মেনে নিবো। এখন তো তেমন কিছু বোঝে না, স্কুলে মিসদের দেখে বাসায় এসে বলে শিক্ষক হবে। সবচেয়ে বড় কথা যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে, আচার-ব্যবহার যেন ভালো হয়। টাকা-পয়সা থাকলে মানুষকে দেবে, আর না থাকলে যেন ব্যবহার দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে।

ুিৃাৃুুাছেলেকে কি ক্রিকেটার বানাতে চান?

না, সে সম্ভাবনা এখন খুব কমই বলা যায়। আমার ছেলে সাহেলের খেলাধুলায় একদম আগ্রহ নেই। ব্যাট-বল স্পর্শই করে না। অবশ্য বলা যায় না, বড় হলে হয়তো খেলাধুলায় আগ্রহী হতে পারে। ছেলে ক্রিকেটার হতে চাইলে আমার কোনও বাধা থাকবে না।

অবসরের পর ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকতে চান?

ক্রিকেট আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এর প্রতিদান তো কিছুটা হলেও দিতে হবে। কী কাজ করবো সেটা নির্ভর করে আমার যোগ্যতার ওপর। এছাড়া আমাকে কে কীভাবে চায় তার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।

রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা আছে?

এটা নিয়ে এখন চিন্তাই করছি না। এখনও আমি খেলছি, আমার চোখ পরের সিরিজের দিকে। অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই আপাতত। অবশ্য ভবিষ্যতের কথা তো কেউ বলতে পারে না!

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশে দিন দিন ইন্টারনেটের প্রভাব বাড়ছে। ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করা উচিত?

আধুনিক যুগের সেরা আবিষ্কার ইন্টারনেট। এক ক্লিকে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে পৌঁছানো যায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে। লেখাপড়া থেকে শুরু করে কর্মজীবন, খেলাধুলা সব জায়গায় এর বিশাল প্রভাব। আমি কারও সম্পর্কে জানতে চাইলে ইন্টারনেটে চলে যাই। সব তথ্য মূহুর্তের মধ্যে দেখে নিতে পারি। তবে সব কিছুতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব থাকবেই। মানুষ ইন্টারনেটকে কীভাবে ব্যবহার করছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কতটা গুরুত্ব দেন আপনি?

আমি খুব কম সময় ফেসবুকে থাকি। ফেসবুকে আমার বন্ধুসংখ্যা সীমিত। খুব বেশি ঘনিষ্ঠ না হলে কাউকে বন্ধু তালিকায় যোগ করি  না। আমি ফান হিসেবেই ফেসবুক ব্যবহার করি। এখানে সিরিয়াস হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ফেসবুকে কেউ সিরিয়াস পোস্ট দিলেও আমি ফান করে মন্তব্য করি। অবশ্য মাঝে মাঝে আমিও সিরিয়াস পোস্ট করি। ফেসবুক ছাড়া অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তেমন ব্যবহার করি না।

ইদানীং আমাদের সমাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ ভালোই প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

মানুষ এখন ফেসবুককে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে। তবে ফেসবুকে কিছু লিখে সমাজে প্রভাব ফেলা খুব কঠিন। কিছু কিছু ব্যাপারে হয়তো প্রভাব ফেলা যায়।  যেমন  রাস্তায় একজন লোক অন্যায় করছে, কেউ সেটার ভিডিও তুলে আপলোড করলে হয়তো ফেসবুকের  প্রভাবটা বোঝা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক ভালো কাজে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় ব্যক্তিগত আক্রমণ কিংবা সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। প্রায়ই দেখা যায়, কোনও ইস্যুতে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ওই বিষয়ে গবেষক হয়ে যান!

ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃতরুণ ক্রিকেটাররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়।  তরুণদের এটা কীভাবে ব্যবহার করা উচিত?

যেসব তরুণ ক্রিকেটার ফেসবুক ব্যবহার করে, তাদের প্রশংসা-সমালোচনা দুটোই মেনে নিতে হবে। নয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করাই ভালো।  যে জিনিস মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, সেটা ব্যবহার না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।  দেখা যায়, কারও খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য বাংলাদেশ হেরে গেলে তার পরিবারের সদস্যদেরও রেহাই দেওয়া হয় না। তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য শুরু হয়ে যায়। আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ভীষণ জরুরি। একটা ছেলে খারাপ খেললে তাকে নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু এখানে তার পরিবার আসবে কেন? গালিগালাজ হবে কেন? কোনও কোনও তরুণ ক্রিকেটার হয়তো সমালোচনা মেনে নিতে পারে। তবে কেউ মেনে নিতে না পারলে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করাই ভালো।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আপনার পরামর্শ কী?

এটা কে কীভাবে ব্যবহার করছে তার ওপর সব কিছু নির্ভর করে। অনেকে মজা করে, অনেকে আবার সিরিয়াস কাজে ব্যবহার করছে। কারও কারও খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আমার মনে হয়, ফেসবুক সময় কাটানোর ভালো  মাধ্যম। তবে এটা ভালো কাজেই ব্যবহার করা উচিত। প্রত্যেকে নিজের অনুভূতি শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে। কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করাই ভালো।

বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?

অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এদেশে। পাঠকদের কাছে দ্রুত খবর পৌঁছে দিতে এই মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে বেশ কিছু ভালো মানের অনলাইন সংবাদপত্রের পাশাপাশি অনেক ভূঁইফোড় অনলাইনও আছে, যারা বানোয়াট সংবাদ প্রচার করে। এগুলো ক্রিকেটারদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম