‘আকবরদের কোচ হিসেবে নিজেকেও চ্যাম্পিয়ন মনে হয়’

মাসুদ হাসান।মাসুদ হাসান-বিকেএসপির প্রধান ক্রিকেট প্রশিক্ষক। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হকের মতো বহু ক্রিকেটার তার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা বাড়িয়েছেন, পেয়েছেন তারকা খ্যাতি।

দেশের ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর থেকে বছরের পর বছর ক্রিকেটার গড়ে তোলার কাজ করে মাসুদ হাসানের চোখে মুখে এখন শোভা পাচ্ছে ভুবনজয়ী হাসি। সম্প্রতি বৈশ্বিক কোনও টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। সেটাও আবার অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটারদের হাত ধরে।

মাসুদ হাসানের তৃপ্তি, প্রশান্তির উৎস সেখানেই। কারণ বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ যুব দলের ৮ ক্রিকেটারই বিকেএসপির ছাত্র। বিশ্বজয়ের পর মঙ্গলবারই প্রথমবার বিকেএসপি প্রাঙ্গনে পা পড়েছে আকবর-পারভেজ-মাহমুদুল হাসানদের। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশের হয়ে খেলছেন তারা। চেনা মাঠে নিজের ছাত্রদের খেলা দেখতে সকালেই হাজির হয়েছিলেন মাসুদ হাসান। সেখানে আকবর-মাহমুদুলদের গড়ে তোলার পেছনের গল্পটা শোনালেন বিকেএসপির এই প্রশিক্ষক।

বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছাত্রদের দেখে কেমন লাগছে?

মাসুদ হাসান: সত্যিই দারুণ লাগছে। ভালো না লাগার তো কোন কারণ নেই, ওরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে এখানে প্রথমবার এসেছে। সকলের মতো আমিও আনন্দিত। ওদের নিয়ে পরিশ্রম করেছি, আজকে পরিশ্রম সার্থক হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। সফল হওয়াতে নিজের কাজের মূল্যায়নও নিজে করতে পারছি।

বাংলা ট্রিবিউন: আকবর-পারভেজ-মাহমুদুলরা তো এখানেই পড়াশোনা করেছেন। এবার তাদের বিকেএসপিতে আসার মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন কিনা?

মাসুদ হাসান: এখন ওরা এসেছে অন্য বেশে। সেই চিরাচরিত বেশ যেটা ছিল, তা আর নেই। এখন দেশের সবার দৃষ্টি তাদের দিকে রয়েছে। সেখানে আমিও ব্যতিক্রম নই।

বাংলা ট্রিবিউন: নিজের ছাত্ররা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, গুরু হিসেবে বিষয়টা হিসেবে কতটা গর্বের..

মাসুদ হাসান: কোচ হিসেবে এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না-কতটা ভালো অনুভূতি। একটা কোচের সাফল্য তখনই, যখন তাদের তৈরি করা কেউ পারফর্ম করে। তাদের পারফরম্যান্স পুরো দেশ উপভোগ করে। এটা বিকেএসপির শপথ বাক্যের সঙ্গে মিলে যায়।

বাংলা ট্রিবিউন: নিজেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মনে হয়?

মাসুদ হাসান: আমিও সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিষয়টা অনুভব করি। তখন কোচ হিসেবে নিজেকেও চ্যাম্পিয়ন মনে হয়।  

আপনারা গণমাধ্যমে কাজ করেন বলে এখন কোচের অনুভূতি জানতে চাইছেন। আপনাদের কাছে এই কথা বললে কেমন লাগবে, সেটি জানা নেই। তবু বলছি-কোন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দল ব্যর্থ হলে সবার আগে কোচকে সাসপেন্ড করা হয়- সব দোষ যেন কোচের। কিন্তু যখন সাফল্য পায়, তখন পুরো দেশ আনন্দ করে। কোচের নাম-ঠিকানা মানুষ জানে কিনা সন্দেহ! আমি আশ্চর্য এবং অভিভূত যে আপনারা পর্দার পেছনের মানুষটিকে খোঁজার জন্য এসেছেন। আমি কৃতজ্ঞ, আপনাদের কাছে আরেকটি অনুরোধ…

মাসুদ হাসানের সঙ্গে প্রতিবেদক।বাংলা ট্রিবিউন: কী সেটা…

মাসুদ হাসান: গ্রামে গঞ্জে অনেক ক্রিকেটার রয়েছে, যাদের তুলে আনেন মফস্বল কোচেরা। বিভিন্ন জেলায় জেলায় আমরা যাই, দেখি কত কষ্ট করে একজন কোচ খেলোয়াড় তৈরি করেন। তাদেরকে আমরা স্যালুট করি। তাদের মতো ডেডিকেশন দিয়ে কাজ কম লোকই করে। তারাও এই সাফল্যের অংশীদার। তাদের প্রোডাক্টইতো আকবর আলী। আমরা সেসব কোচদের থেকে আকবরদের মতো ক্রিকেটাদের এখানে নিয়ে এসেছি। তাদের স্যালুট, বিনাশ্রমে এবং বিনা লাভে এমন পরিশ্রমের জন্য। আমরা তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে পারলে তারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে। ওদেরকে সমাজের কাছে পরিচিত করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। পর্দার অন্তরালের মানুষদের আপনারা সামনে নিয়ে আসুন।

বাংলা ট্রিবিউন: বিকেএসপির ৮ জন ছাত্র বিশ্বকাপ দলের সদস্য ছিল, এদের নিয়ে বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখেছিলেন?

মাসুদ হাসান: ওইভাবে স্বপ্ন দেখেছি তা নয়, তবে বিশ্বাস ছিল ওরা সেমিফাইনাল খেলবে। যখন দেখলাম ফাইনালে চলে গেলো, তখন আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেলো। আমি ওইদিন থেকেই বিশ্বাস করা শুরু করেছি, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরতে পারবো।

বাংলা ট্রিবিউন: ঠাণ্ডা মাথার অধিনায়ক হিসেবে নাম কুড়িয়েছে আকবর, সে কি আগে থেকেই এমন ঠাণ্ডা মাথার ক্রিকেটার?

মাসুদ হাসান: আকবর তো আকবরই। এখানে অন্যান্য কোচরাও রয়েছে। আমার ডিপার্টমেন্টে যারা রয়েছে, সবাই তাকে আদর করে। ওদের ব্যাচের মধ্যে সাতজন ছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধীরস্থির আকবর। সবকিছু খুব ভালো করে হ্যান্ডেল করতে পারে। ওর চিন্তা ভাবনা খুব স্বচ্ছ। খেলার সময় তখন শুধু খেলা নিয়েই চিন্তা করে। যখন সতীর্থদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, তখন অন্যরকম থাকে ও (আকবর)।

বাংলা ট্রিবিউন: নেতৃত্বের ব্যাপারটি তার মধ্যে কি আগে থেকেই ছিল?

মাসুদ হাসান: লিডারশিপটা তার মধ্যে ছিল। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে এমনটা বুঝতে পারা অনেক বড় কিছু। ওকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, আকবরের মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমিও ভাবিনি। আমি চিন্তা করেছি ওদের সবাইকে কীভাবে ট্রেন-আপ করা যায়। আর ও চিন্তা করেছে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। তখনই বুঝতে পারি, আকবর অসাধারণ।

বাংলা ট্রিবিউন: বিষয়গুলো আসলে কেমন, যদি ব্যাখ্যা দিতেন…

মাসুদ হাসান: সাকিব আল হাসান যখন এখানে ছাত্র ছিল তখনও তাদের গ্রুপের কোচ ছিলাম আমি। গ্রুপ ম্যাচ বা ইন্টার্নাল ম্যাচগুলার সময় বলতাম, ট্রেনিংয়ে টেকনিক্যালি এই কাজগুলা করবো। প্রচলিত ভাষায় বলে না, ‘ক বললে কলকাতা বুঝে যাওয়া।’ অনেক ছাত্রকে হয়তো বারবার যেটা বলা লাগত, তেমনটা ওকে (আকবর) বলা লাগেনি।

বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি শুরুতে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পেই আকবরের নাম ছিল না, কীভাবে এলো তার নাম?

মাসুদ হাসান: আমি তার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। বিসিবি বা নির্বাচকদের সঙ্গে কথা বলেছি, কোনওভাবে কোনও রাস্তা তৈরি করা যায় কিনা। তবে সেই সুযোগটা মিলে যায় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিকেএসপিতে তিনটি অনুশীলন ম্যাচ খেলতে এসেই। বিসিবি থেকে আমাদের জানানো হলো, ‘আমরা তিনটি ম্যাচ খেলবো, আপনাদের দল তৈরি আছে কিনা।’ আমি তখন ভাবলাম, এটাইতো সুযোগ। স্যারের (বিকেএসপির প্রিন্সিপ্যাল কর্নেল ইমরান)সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন, এটাই মোক্ষম সুযোগ। ম্যাচের ব্যবস্থা করো।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই নাকি ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিল আকবর। সেটাই কি আকবরের জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল?

মাসুদ হাসান: অবশ্যই, ওই ম্যাচে আকবর ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিল। প্রথম ম্যাচে আমি এবং হান্নান সরকার ছিলাম। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের টিম ম্যানেজমেন্টের যারা ছিল, তাদের সঙ্গে কথা বললাম। আমি হান্নানকে বললাম, দেখো আমি কোন তদবির-সুপারিশ করছি না, কোন না কোনওভাবে ভুল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ও সুযোগ পেলে তোমাদের আশা পূরণ করতে পারবে। ছোটভাই হিসেবেই হান্নানকে বললাম।

বাংলা ট্রিবিউন: এরপর….

মাসুদ হাসান: ম্যাচ তখন চলছিল, বিকাল বেলায় আমাকে ডেকে আমার কাছে আকবরের পাসপোর্ট চাইলো। আমি তখনই আকবরকে হোস্টেলে পাঠিয়ে তার পাসাপোর্ট আনার ব্যবস্থা করি। আমি পাসপোর্ট হাতে পেয়ে চার নম্বর মাঠ থেকে দৌড়ে অফিসে গিয়ে ফটোকপি করে হান্নানের কাছে দেই। অনূর্ধ্ব-১৯ দল তিনটা ম্যাচ খেলে চলে গেলো। কিছুদিন পর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের স্কোয়াডে দেখি আকবর আলীর নাম। সেই শুরু, ছেলেটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরলো।

বাংলা ট্রিবিউন: ৮জন বিকেএসপির ক্রিকেটার আছেন চ্যাম্পিয়ন দলে। এদের মধ্যে কারা লম্বা পথ পাড়ি দিতে পারবেন বলে মনে করেন?

মাসুদ হাসান: কোচ হিসেবে যেটা চিন্তা করি, আকবর আলী তো আছেই। যদিও সবাই আমার ছাত্র। এভাবে নাম বললে ওরা মনে করবে ‘স্যার আমার কথা বললেন না, ওর কথা বললেন’। তারপরও আমার দেখা মতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে মামুদুল হাসান জয়কে। তার ওপর নির্ভর করা যায়। আছে শামীম হোসেন, ও অলরাউন্ডার। কিন্তু ফোকাস ধরে রেখে খেলতে হবে। কারণ, মাহমুদুল হাসান যে মেন্টাল ফ্রেমের মধ্যে আছে। শামীমের সে রকম ফ্রেম না। শামীম টেকনিক্যালি খুব ভালো প্লেয়ার। এর বাইরে পারভেজ হোসেন ইমন রয়েছে। ও ভালো, মাঝে মাঝে হয়তো একটু আনস্টেবল হয়ে যায়। এদেরকে একটু বেশি করে যত্ন নিতে পারলে দেশের জন্যই ভালো হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: দেখা যায় বয়সভিত্তিকের ধাপ পেরিয়ে বড়দের ক্রিকেটে গেলেই অনেক ক্রিকেটার হারিয়ে যায়, এদের নিয়ে কীভাবে কাজ করা যায়?

মাসুদ হাসান: অবশ্যই কাজ করার রয়েছে। কারণ স্বাভাবিকভাবে ক্লাস ওয়ান টু করে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। এভাবেই তো যাচ্ছি, এটাই স্বাভাবিক, অনূর্ধ্ব-১৯ থেকেই তো জাতীয় দলে যাবে। ওখানে একটু বিশেষ ক্ষেত্র তো রয়েছেই। জাতীয় দল বা ‘এ’ দল বলেন, ওজনটা নেওয়ার মতো কতটুকু ক্ষমতা আছে, সেটা বিবেচনা করতে হবে। এটা যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করতে পারা। অনেকেই নিতে পারে, যেমন আকবর আলী, সে বোঝে কোন ব্যাপারটা কীভাবে করতে হবে।