রোহিঙ্গাদের ফুটবল মাঠের লড়াই

রোহিঙ্গা ফুটবল দলমোহাম্মদ ফারুক প্রায়ই খেতে আসেন কোতারায়া কমপ্লেক্সের কাছের এক মিয়ানমার রেস্টুরেন্টে। কুয়ালালামপুরে এই রেস্টুরেন্টে তার মতো অনেক রোহিঙ্গাই ভিড় জমান প্রতিদিন। তাদের কেউ এসেছেন আইনি পথে, কেউ বেআইনিভাবে। মালয়েশিয়ানদের কাছে জায়গাটা তাই ‘বিপজ্জনক’। যদিও ফারুকের কাছে কুয়ালালামপুর ‘নিজের ঘরের’ মতো। মালয়েশিয়ার রাজধানীর খাবারের দোকানটা ২৪ বছর বয়সী তরুণের চোখে দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরের নিজের দেশের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ জায়গা।

ফারুক সেটা না বললেও চলতো। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন দেখে বিশ্বের অজস্র মানুষের চোখ আজ অশ্রুসজল। ঘর-বাড়ি হারিয়ে জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশে। বর্তমান ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অনেক আগেই অবশ্য দেশ ছেড়েছিলেন ফারুক, যিনি এখন কাজ করছেন কুয়ালালামপুর ভিত্তিক রোহিঙ্গা ফুটবল দলের সেক্রেটারি হিসেবে।

ফিফার তালিকাভুক্ত নয়, পৃথিবীর মানচিত্রে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া, সংখ্যালঘু কিংবা ঘরবাড়ি হারানো- এমন দলগুলোকে নিয়ে ২০১৩ সালে গঠিত হয় কনফেডারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্ট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা কনইফা। দুটো বিশ্বকাপ হয়ে গেছে তাদের। রোহিঙ্গা ফুটবল দলও এখন স্বপ্ন দেখছে কনইফা বিশ্বকাপে খেলার। জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ধাক্কা খাওয়া কুয়ালালামপুরের রোহিঙ্গাদের এই স্বপ্ন ঘরহারা অনেক রোহিঙ্গাকে সাহস জোগাচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যে নিজেদের গোত্রের মানুষের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র দেখে  রোহিঙ্গা ফুটবল দলের ৩৫ সদস্য মাঝেমধ্যে সাহস হারিয়ে ফেলেন। তবে শোককেই আবার শক্তিতে রূপ দেন তারা। ফারুকের কণ্ঠের তীব্রতায় সেটা বোঝা যায় খুব, ‘আমরা ঠিকঠাক অনুশীলন করতে পারি না। রাখাইনে যা ঘটছে, সেটার কথা ভাবলে মনে হয় ফুটবল খেলা উচিত নয় আমাদের। কিন্তু আমরা লড়াই করছি, করতেই হবে। কারণ আমরাই প্রথম গড়েছি রোহিঙ্গা জাতীয় ফুটবল দল।’

রাখাইনে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাস করছেন মালয়েশিয়ায়। তাদেরই একজন আবু তৈয়ব। রোহিঙ্গা ফুটবল দলের এই খেলোয়াড় রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ২০১২ সালে। ১৫ দিন নৌকায় কাটিয়ে তিনি পৌঁছান মালয়েশিয়ায়। ফারুক জানিয়েছেন, গত ২৬ আগস্ট তৈয়বের দুই চাচাকে মেরে ফেলেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তার পরিবারের বাকি সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়া তৈয়ব মালয়েশিয়ায় ঘাস কাটার কাজ করার পাশাপাশি নেমেছেন ফুটবল লড়াইয়ে। ২১ বছর বয়সী এই তরুণও স্বপ্ন দেখেন কনইফা বিশ্বকাপে খেলার।

শিরোপা হাতে রোহিঙ্গা ফুটবল দলের উল্লাসরোহিঙ্গা ফুটবল দলের ৩৫ সদস্যের জীবন-কাহিনী প্রায় একই। ঘরবাড়ি-পরিবার ছেড়ে, সব কিছু হারিয়ে যন্ত্রণার জীবন পার করেছেন প্রত্যেকে। তবে ফুটবলকে  হাতিয়ার করে অধিকারের আন্দোলন করতে চান দৃঢ়তার সঙ্গে। প্রত্যেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। ফারুক জানিয়েছেন, ‘প্রত্যেক মাসে আমরা তিন হাজার রিঙ্গিত পাঠাই বাংলাদেশে। কখনও কখনও সেটা যায় আমাদের নিজেদের পকেট থেকে।’

এগিয়ে চলার স্বপ্ন তাতে আরও বড় হয় ফারুকদের। বাধা পেরিয়ে, নতুন দিনের আশায় বুক বাধেন তারা। যেখানে তাদের ঢাল ফুটবল, আর ভাবনায় রোহিঙ্গাদের অধিকার।