ইন্টারনেট ‘ধীর গতিতে’ রাখার নির্দেশ: ক্ষতি দেখছেন উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা

ইন্টারনেট সেবা

চলতি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখতে সব আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশনা দিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এ নির্দেশনায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

ই-কমার্স ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ওই আড়াই ঘণ্টা সময় তাদের জন্য ‘পিক আওয়ার’। এ সময়ে ইন্টারনেটের গতি কম থাকলে অফিসের করপোরেট যোগাযোগ বিঘ্নিত হবে, এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলায় সমস্যা দেখা দেবে। এছাড়া অ্যাপস নির্ভর গাড়ি সেবা– ‘উবার’, ‘চলো’, ‘পাঠাও’ ব্যবহার করা যাবে না, ই-কমার্স সেবা বন্ধ থাকবে, ব্যাংকের সার্ভার চালু করতে না পারার মতো (ফলে দেনদেন দেরিতে শুরু হবে) শতেক ঘটনা ঘটবে। তাই তারা ইন্টারনেট ‘ধীর গতিতে’ রাখার নির্দেশে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।

ই-কমার্স ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা আরও জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোমবার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস। এদিন সকালে ইন্টারনেটের গতি কম হলে তাদের করপোরেট যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এ সময় আন্তর্জাতিক যোগাযোগও বন্ধ থাকবে। তৈরি পোশাক খাতের অর্ডার নেওয়া বা মেইল পাঠানো যাবে না, বায়িং হাউসের কাজ বন্ধ থাকবে, ইন্টারনেট নির্ভর কল-সেন্টার থেকে সেবা পাওয়া যাবে না, ফেসবুক কেন্দ্রীক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ডার করা যাবে না, যেসব স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা চালু রয়েছে সেসব স্কুলে শিক্ষার্থীরা প্রবেশের সময় সমস্যায় পড়বে, অনলাইন স্কুলের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটবে।

এদিকে, ইন্টারনেট ধীর গতিতে রাখার নির্দেশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকে মন্তব্য করেছেন, প্লেট চুরির ভয়ে ভাত মাটিতে রেখে খাবারের আয়োজন চলছে দেশে। অনেকে বলেছেন, গোড়ায় গিয়ে রোগ চিহ্নিত না করে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটার আয়োজন করা হচ্ছে। এতে তেমন সুফল মিলবে না। এসব ফেসবুক ব্যবহারকারীর অনেকের প্রশ্ন, যদি দুই ঘণ্টা আগেই (ইন্টারনেট সচল থাকার সময়) প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তাহলে সে দায়িত্ব কে নেবে।

প্রযুক্তিবিদরা বার বার বলে আসছেন, ইন্টারনেট বন্ধ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না। এর আগে বেশ কয়েকবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো সমস্যা ইন্টারনেট বন্ধ করে সমাধান সম্ভব নয়। তবু ইন্টারনেট ধীর গতিতে রেখে এ সমস্যার সমাধানে নেমেছে সরকার। প্রযুক্তিবিদদের আশঙ্কা, এভাবে সাময়িক সময়ের জন্য সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

এ ব্যাপারে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, ‘সকালে সাধারণত করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কমিউনিকেশনের কাজ হয়। ইন্টারনেটের গতি কম থাকলে এ কাজে বড় ধরনের সমস্যা হবে। এ ধরনের ঘটনা একাধিক দিন ঘটলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়বে দেশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইএসপিগুলোকে ২৫ কেবিপিএস ব্যান্ডউইথ সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা দিয়ে তো আমাদের নেটওয়ার্কই ওপেন (চালু) হবে না। ডিএনএস কাজ করবে না। তাহলে পুরোপুরি বন্ধ না করে এই গতিতে চালু রেখে লাভ কী? গতি কমানোর কথা বলা হলেও কার্যত ইন্টারনেট বন্ধই থাকবে।’ তার আশঙ্কা, ‘সকালে ইন্টারনেট বন্ধের পর আবার চালু হলেই কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বোঝা যাবে।’

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, ‘দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক কেন্দ্রীক উদ্যোক্তা রয়েছেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে তাদের অনেক ক্ষতি হবে। অর্ডার না পেলে তাদের ব্যবসায়ে ধস নামবে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘এর আগে ফেসবুক বন্ধ থাকার সময় উদ্যোক্তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল।’

অ্যাপসনির্ভর অন ডিমান্ড কার সার্ভিস ‘চলো’র প্রধান নির্বাহী দেওয়ান শুভ বলেন, ‘সকালে আমাদের অনেক কল আসে গাড়ির জন্য। ইন্টারনেট না থাকলে বা গতি কম হলে অ্যাপস চলবে না, কল সেন্টার না চললে গাড়িও রাস্তায় নামতে পারবে না। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছি নিশ্চিতভাবে।’

দেশের অনলাইন পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাজ অনলাইনেই করে থাকেন। সময় বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রাত ও সকালকেই তারা ‘উত্তম সময়’ বলে মনে করেন। এসময় তারা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিটিং, ভিডিও সম্মেলন করে থাকেন। অনেকে মেইলে কাজ পাঠিয়ে থাকেন। তাদের ভাষ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের আদর্শ সময় সকাল। সে সময়েই বিঘ্ন ঘটবে নেটের। ফলে তারাও বড় ধরনের সংকটে পড়বেন।

ফ্রিল্যান্সার মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি সাধারণত খুব সকালে কাজ করি। অনেককে এসময় কাজ ভাগ করে দিই। তাই সকালে নেটেই থাকতে হয়। সকালে নেট না পেলে কাজ করবো কীভাবে। সরকারের অবশ্যই একটা বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

প্রসঙ্গত, চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগে থেকে মোট আড়াই ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে ধীর গতি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা পর (সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত) ইন্টারনেট ধীর গতিতে চলবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি থেকে দেশের সব আইআইজিকে (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) এই নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া ধীর গতিতে ইন্টারনেট চালানোর সিদ্ধান্ত পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নে রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবার গতি ধীর ছিল। আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরগুলোতে ২৫ কেবিপিএস (কিলোবিট পার সেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ সরবরাহর কারণে কার্যত বন্ধই ছিল ইন্টারনেট। এসময় কোনও ওয়েবসাইটে ঢোকা যায়নি। কিছু সার্চ দিলেও ওয়েবপেজগুলো কেবল ‘লোডিং’ দেখাচ্ছিল।