কমেছে টিভি মেরামতের কাজ

‘একসময় কেউ টিভি সার্ভিসে দিলে তিন দিন পর্যন্ত দোকানেই পড়ে থাকতো। হাতে এত কাজ থাকতো যে দুই দিনের আগে নতুন কাজ ধরার সুযোগই ছিল না। আর এখন কাজই নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন মিরপুর ১১ নম্বরে বড় মসজিদ এলাকার টিভি মেকানিক মো. সেলিম।

প্রায় ৫০ বছর বয়সী মো. সেলিম গত ২৫ বছর ধরে একই এলাকায় টিভি মেরামতের কাজ করে আসছেন। এর মাঝে সময় বদলেছে। এখন নিত্য-নতুন আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোড়গোড়ায়। তারই ধারাবাহিকতায় পুরাতন সিআরটি টিভির পরিবর্তে এসেছে নতুন এলইডি টিভি। আধুনিক সব সুবিধাযুক্ত এসব এলইডি টিভি তুলনামূলক নষ্ট কম হয়। ফলে এলাকাভিত্তিক টিভি মেকানিকদের কাজও কমে এসেছে বলে জানান সেলিম।

বেশিরভাগ টিভি উৎপাদনকারী কোম্পানি ওয়ারেন্টি দেয় বলে ক্রেতারা তাদের কাছেই যান

তিনি বলেন, ‘আগে বক্স টিভিগুলোর টুকিটাকি নানান কাজ ছিল। কোন একটা টিভি সার্ভিসে আসলে ২০০-৫০০ টাকার কাজ থাকতো। এখন এলইডি টিভিগুলোর খুচরা কোনও কাজ নাই। এগুলোর মূল যন্ত্রাংশই হলো ডিসপ্লে প্যানেল, ব্যাক লাইট আর মেইন বোর্ড। এর মধ্যে মেইন বোর্ডে কিছু হলে ঠিক করে দেওয়া যায়। ডিসপ্লে বা ব্যাক লাইট নষ্ট হলে নতুন কিনে এনে লাগিয়ে দেই। সেইখান থেকে যা লাভ করতে পারি। তবে সেই কাজও সব সময় আসে না। মাসে দুই একটা। কোম্পানি ওয়ারেন্টি দেয়, আবার তাদের সার্ভিস সেন্টারও আছে। সেখানেই যায় সবাই।’

২০১০ সালের পর থেকেই টিভি মেয়ামতের কাজে ভাটা এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বক্স টিভির বাজার ভালো ছিল। ২০১০ এর পর থেকে সেই বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। সব কিছুরই শেষ আছে, নতুন আসবে পুরাতন জিনিস বন্ধ হবে। এখন তো ক্যাসেট প্লেয়ার নাই। মোবাইলে সব পাওয়া যায়। ভিসিয়ার, ডিভিডি এগুলাও মার্কেট আউট।’

ঠিক না কলে অনেকে পুরনো টিভি বিক্রি করে দেন, সেগুলো ঠিক করে কম দামে বিক্রি করেন মেকানিকরা

টিভি মেরামতের কাজ কমে আসলেও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য মেরামত করে জীবন চলে বলে জানান একসময় ব্যস্ত সময় কাটানো টিভি মেকানিকরা। তাদের বেশ কয়েকজন জানান, আগের সিআরটি টিভিগুলার নানা পার্টস ঠিক করার মতো কাজ ছিল। তবে বর্তমানে এলসিডি বা এলইডি টিভি ম্যাকানিজম কম। সার্ভিসের তেমন কিছু নেই। টিভির সব পার্টস বাজারে কিনতেই পাওয়া যায়। নষ্ট পার্টস ঠিক করার চাইতে নতুন পার্টস লাগিয়ে নেন টিভি মালিকরা। এই পার্টস লাগানো বাবদ কিছু টাকা পান টিভি মেকানিকরা। এতে তেমন আয় হয় না। তাই অনান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র - চার্জার ফ্যান-লাইট,  ব্লেন্ডার, মাইক্রোওভেন এসব মেরামত করে চলার মতো আয় করেন টিভি মেকানিকরা।

শুক্রাবাদের এলাকার টিভি মেকানিক নুর আলম বলেন, একটা এলইডি টিভি সার্ভিসে ২ থেকে ৪ হাজার বা তার বেশিও খরচ হয়। আর প্রতিনয়তই নতুন মডেলের টিভি আসছে বাজারে। ৪-৫ বছর গেলেই পুরনোটা বদলে বা নষ্ট হয়ে গেলে নতুন টিভি কেনেন সবাই। ঠিক করে ব্যবহার খুব কম লোকই করে। তখন ওই নষ্টগুলো কমে কিনে ঠিক করে আমরাই বিক্রি করি। এর পাশাপাশি বাসাবাড়িতে অন্যান্য যেসব ইলেকট্রিক জিনিসপত্র আছে ওইগুলো সার্ভিস করে দিন চলে।

টিভির বদলে অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য মেরামত করে জীবন চলে বলে জানান একসময় ব্যস্ত সময় কাটানো টিভি মেকানিকরা

কাজ কম, তবে কাজ সহজও হয়েছে বলেও জানিয়ে মিরপুর-১১ এর আরেক টিভি মেকানিক ইউসুফ বলেন, আগের মেকানিকরা যে খুব দক্ষ ছিলেন তাও না। বুঝে বুঝে কাজ করতেন। এখন তো আমরা যেকোনও টিভির সেটাপ ম্যানু দেখেই বুঝে ফেলি। তার ওপর ইন্টারনেট আছে। যা জানার দরকার জানতে পারি। এখন বড় কাজ না থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে দেই।

নিত্যনতুন ইলেকট্রিক পণ্য সম্পর্কে ধারণা থাকলে এই পেশায় টিকে থাকা সহজ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অনেকই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে। আগের মতো এলাকাগুলোতে টিভি সার্ভিসিংয়ের দোকান খুব একটা দেখবেন না। তবে এখন আর শুধু টিভির ওপর ভরসা না করে অনান্য ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিও যদি ভালো সার্ভিস দেওয়া যায়, তাহলে আয় কম হয় বলে মনে হয় না।

ছবি: প্রতিবেদক।