সবুজের সমারোহে সম্ভাবনার কর্মযজ্ঞ

বাসের যাত্রীদের অধিকাংশই গণমাধ্যমকর্মী। গন্তব্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি। রাজধানীর যানজট ঠেলে যখন হাইটেক সিটিতে পৌঁছালাম তখন তপ্ত দুপুর। ধীরগতির যাত্রায় সবার মধ্যে একটা ঝিম ধরা ভাব। ভরা বর্ষাকালেও দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই, গাড়ি থেকে নেমে বাতাসের জোর টের পাওয়া গেল বেশ। তারপরও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত, গরম বাতাস। তবে হাইটেক সিটির অবারিত গাঢ় সবুজ প্রশান্তি এনে দিলো। এই ভর দুপুরেও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে এলো। রাস্তার ধারে ফুটে থাকা নাম না জানা বুনোফুলের গন্ধও ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে, যান্ত্রিক শহর ছেড়ে কোনও এক অজ পাড়া-গাঁয়ে এসে নামলাম মাত্র।21b

হাইটেক সিটির কথা শুনলেই মনে প্রথম যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, তা হলো উঁচু উঁচু ভবন, চারিদিকে প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। হয়তো থাকতে পারে রোবট কিংবা পণ্য উৎপাদনের যাবতীয় সহায়তার অনুষঙ্গের আনাগোনাও। সবমিলিয়ে প্রাণ-প্রযুক্তির নানা প্রকারের চেহারা। কিন্তু গত রবিবার (৩১ জুলাই) গাজীপুরের কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে গিয়ে এর বিপরীত চিত্রটাই চোখে পড়লো শুরুতেই।

বিশাল খোলা প্রান্তর, উদ্দাম হাওয়া, চোখ জুড়ানো সবুজের মাঝে কোথাও কোথাও অনুচ্চ ভবন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সবে। কিছু কিছু ভবন মাথা তোলার চেষ্টা করছে। চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। হাইটেক সিটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে রাজধানীর সঙ্গে দেশের উত্তর ও পশ্চিমের জেলাগুলোর যোগাযোগের মাধ্যম রেলপথ।

সিটির ভেতরে প্রবেশ করা হলো আরেকটি যানে। বিশাল এলাকার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে থামলো সেই যান। শুরুতেই প্রবেশ করলাম নতুন সোলারিস ভবনে। এই ভবনে রয়েছে বাংলাদেশ টেকনোসিটি লিমিটেড ও ফেলিসিটি আইডিসি ইন্টারনেট ডেটা-সেন্টার নামের দুটি প্রতিষ্ঠান।পরবর্তী সময়ে একে একে দেখা হলো নকিয়া মোবাইলের কারখানা, অরিক্স-বায়োটেক প্রতিষ্ঠান ভবন। 21c
এখানেই রয়েছে সরকারের প্রথম ফোর টিয়ারের ডাটাসেন্টার। এটিকেই বলা হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ডাটাসেন্টার। চীনের জেডটিই’র প্রযুক্তি সহায়তায় ডাটা সেন্টারটি তৈরি হচ্ছে। এখানে পাবলিক-প্রাইভেট সব ধরনের ডাটার সংস্থান হবে বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এখানে রয়েছে নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ, উচ্চগতির ইন্টারনেট, যাতায়াতের জন্য সুন্দর রাস্তা, আবাসিক ব্যবস্থা, সার্বক্ষণিক পানি ও সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই পার্কে বিনিয়োগকারীদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত থাকছে কর অবকাশ সুবিধা। আবার এখানে উৎপাদিত পণ্য রফতানি করলে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থাও রয়েছে। এ সবের সুফল পেতে শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি।    

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের কাছে জানতে চাইলে তিনি হাইটেক সিটি সম্পর্কে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে এরই মধ্যে ৮২টা কোম্পানি ৫৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আগামী ৫ বছরে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে এখানে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগামী ১০ বছরে এখানে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান হবে। এজন্য আগামী ৫-১০ বছরে এখানে হাইটেক টাউনশিপ ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে যাবে।’21d

ডেটাকে আগামী দিনের তেল (জ্বালানি) উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যার হাতে যত ডেটা তিনি তত ধনী। ফলে ডেটা যেমন খুব দামী ও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এটাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এরইমধ্যে ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্টের খসড়া তৈরি হয়েছে। শিগগিরই আমরা অংশীজনদের সঙ্গে বসে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।

প্রতিমন্ত্রী জানান, কাওরান বাজার জনতা টাওয়ার টেকনোলজি পার্ক, যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, রাজশাহী হাইটেক পার্কে কোনও খালি জায়গা নেই। অন্যান্য হাইটেক পার্ক নির্মাণ শেষ হলে এমন চিত্র দেখা যাবে বলে আমি আশাবাদী।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি নিয়ে আমি একটু বেশিই আশাবাদী। কাছেই রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় রয়েছে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন নতুন আরও হচ্ছে। কাছেই বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। টাঙ্গাইলও এখান থেকে কাছে। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে কর্মস্থানের জায়গা হিসেবে সহজেই হাইটেক পার্ককে বেছে নিতে পারবে। ফলে সবকিছু মিলয়ে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে নিয়ে আমি আশাবাদী।

যারা বিনিয়োগ করেছে

অরিক্স-বায়োটেক, স্যামসাং মোবাইল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস, নকিয়া মোবাইল ফোন, হুন্দাই মোটর, ওয়ালটন, টেকনো মোবাইল, সনি র‌্যাংগস, বিজেআইটি, সিম্ফনি মোবাইল ফোন, আজিয়াটা, লিও ক্যাবলস, কেমন ক্যাবলস, উল্কাসেমি, থিংক গ্রুপ, ফেলিসিটি আইডিসি লিমিটেড, বাংলাদেশ টেকনোসিটি লিমিটেড, কেডিএস গ্রুপ, ইন্টারক্লাউড, বিজনেস অটোমেশন, নাসডাক টেকনোলজিস, জেআর এন্টারপ্রাইজ, বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড, ডেটা সফট, আমরা হোল্ডিংস, ভেড নেট লিমিটেড, মিডিয়া সফট, ডেটা সিস্টেম লিমিটেড, ইউওয়াই সিস্টেম লিমিটেড, এসবি টেল এন্টারপ্রাইজ, ইউনিকম বাংলাদেশ ও সিস্টেক ডিজিটাল-সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক বিনিয়োগের জন্য আদর্শ। কারণ- এখানে রয়েছে বড় স্কেলে হাইটেক ইলেকট্রনিকস, হার্ডওয়্যার উৎপাদনের সুযোগ (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, সেমিকন্ডাক্টর, মাদারবোর্ড ইত্যাদি), বায়োটেকনোলজি, ব্যাটারি প্রযুক্তি,মোটরগাড়ি এবং আইটি ও আইটিইএস (সফটওয়্যার বা বিপিও) সামগ্রী উৎপাদনের সুযোগ।

এক নজরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির আগের নাম ছিল কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক। ২০১৬ সালে নাম বদলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি। ১৯৯৯ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সভায় কালিয়াকৈরে ২৩১ একর জমিতে হাইটেক পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে এর আয়তন বাড়িয়ে করা হয় ৩৫৫ একর।

৩৫৫ একর জমির ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। এতে রয়েছে ৬টি ব্লক। এরমধ্যে ১ নম্বর ব্লকে রয়েছে ৬৫ একর জায়গা, দুই নম্বর ব্লকে ৬২ একর, তিন নম্বর ব্লকে ৪০, চার নম্বর ব্লকে ৩৬, পাঁচ নম্বর ব্লকে ২৯ এবং ৬ নম্বর ব্লকে ৯৭ একর জমি রয়েছে।21f