শতকোটি টাকা রাজস্ব হারানোর শঙ্কা

নিয়মের বাইরে আইটিসির কাছে ব্যান্ডউইথ বেচতে চায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি

নিয়ম নেই, তারপরও আইটিসির কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে চায় বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি (বিএসসিপিএলসি)। এতে করে সরকারি ব্যান্ডউইথ রফতানির সুযোগ পেতে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড। এই সিদ্ধান্তে সরকারের শতকোটি টাকা রাজস্ব হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগের কাজ করে সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) অপারেটর। এই দুই অপারেটর থেকে পাইকারি দরে ব্যান্ডউইথ কেনে দেশের ৩৪টি আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে)। এরপর আইএসপি (ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে ইন্টারনেট সেবা। বর্তমানে ৫ হাজার ২০০ জিবিপিএস চাহিদার মধ্যে ২ হাজার ২০০ জিবিপিএস দিচ্ছে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি। ৩ হাজার জিবিপিএস ভারত থেকে আমদানি করে ৬টি আইটিসি অপারেটর।

বর্তমানে দেশের প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল ‘সি-মি-উই-ফোর’ এর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭  হাজার ২০০ জিবিপিএসে। আইটিসি হিসেবে এখান থেকে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ ছাড়ে এক টেরা (এক হাজার জিবিপিএস) ব্যান্ডউইথ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড নামের আইটিসি প্রতিষ্ঠান। এ অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠিও সাবমেরিন ক্যাবল লিমিটেড পিএলসি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যৌথ ব্যবসার পাশাপাশি ভারতে ব্যান্ডউইথ রফতানিও করতে চায় এই ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড। অপরদিকে সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি পর্ষদ সভার অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ছাড়ে (ডিসকাউন্ট) ব্যান্ডউইথ দিতে পারবে বলে মত দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির এমন প্রস্তাবনা নীতিমালার লঙ্ঘন বলে অভিযোগ তুলেছে টেলিকম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) অনুমোদন নিয়ে আইটিসি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশ থেকে ব্যান্ডউইথ কিনতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মির্জা কামাল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড চিঠি দিয়ে তাদের আইটিসি লাইসেন্সের আওতায় এক টেরা ব্যান্ডউইথ কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদেরকে অনুমোদন দিলে অন্যরাও (আইটিসি) নিতে পারবে।  শুধু একজনকেই তো আর দেওয়া যাবে না। দিলে সবাইকে অনুমোদন দেওয়া হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা কামাল আহমেদ বলেন, ‘কোনও আইটিসি কোম্পানির ক্ষেত্রে নিজের দেশ থেকে ব্যান্ডউইথ কেনার নিয়ম নেই। তবে তারা বিটিআরসির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে কিনতে পারবে। যা কিছু হবে সব নিয়ম মেনে।’

জানা গেছে, এ বিষয়টির জন্য বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল পিএলসি আইপি ট্রানজিটের মূল্য হ্রাস এবং ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেডের বাল্ক পরিমাণ ব্যান্ডউইথ কেনার প্রস্তাব যাচাই বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি গত ২১ ডিসেম্বর একটি বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকের পর কমিটি একটি প্রতিবেদনও দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির কাছে ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবালের বকেয়ার পরিমাণ ২৩ কোটি ৬৪ লাখ ৬৮ হাজার ২২৪ টাকা (২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত)। এই পদ্ধতিতে ব্যান্ডউইথ বিক্রির আগে ফাইবার অ্যাট হোমের সব বকেয়া পরিশোধ করতে হবে।’ জানা গেছে, ফাইবার অ্যাট হোমের সিকিউরিটি ডিপোজিটের পরিমাণ ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবালের আইটিসি এবং আইআইজি- দুটো লাইসেন্সই আছে। নীতিমালা অনুযায়ী, সাবমেরিন ক্যাবল থেকে আইআইজি হিসেবে ব্যান্ডউইথ কিনতে পারবে তারা। কিন্তু আইটিসি হিসেবে কেনার সুযোগ নেই। আবার ভারত থেকে আইটিসি হিসেবে ব্যান্ডউইথ এনে দেশে সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ব্যান্ডউইথ রফতানির সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আইআইজি অপারেটরগুলোর ১০০ থেকে এক হাজার জিবিপিএস বাল্ক ব্যান্ডউইথ কিনতে প্রতি এমবিপিএসে খরচ হয় ১৩৫ থেকে ১৬৮ টাকা। বিপরীতে ১০ শতাংশ ছাড়ে এক হাজার জিবিপিএস কিনতে প্রতি এমবিপিএসএ ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবালের খরচ আরও কম পড়বে। ব্যবসায়িক কারণে এসব ব্যান্ডউইথ অন্য আইআইজিগুলোর কাছে বর্তমান বাজার দরের চেয়েও কমদামে বিক্রি করতে পারবে। এতে করে বাজারে একটি ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এই সিদ্ধান্ত এ খাতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে।

বিষয়টি জানতে চাইলে ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মশিউর রহমান বলেন, ‘বিএসসিপিএলসি থেকে আমরা এখনও কোনও সিদ্ধান্ত পাইনি। বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যান্ডউইথ রফতানির বিষয়ে বিএসসিপিএলসির সহযোগী বা পার্টনার হতে চাই। বিএসসিপিএলসির ব্যান্ডউইথ রফতানিতে প্রথমে বিটিসিএল পার্টনার হয়েছিল। এবার ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড শরিক হতে চায়।’

এ বিষয়ে আইআইজি ফোরামের মহাসচিব আহমেদ জুনায়েদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকটি আইআইজি ছাড়া বাকিগুলো আইটিসির সঙ্গে একটি বান্ডেল প্যাকেজে শিফট করবে। এখানেই শেষ নয় আইটিসিরা আয়ের এক শতাংশ, সাবমেরিন ক্যাবল ৩ শতাংশ এবং আইআইজি অপারেটররা আয়ের ১০ শতাংশ ভাগাভাগি (রেভিনিউ শেয়ার) করে বিটিআরসি’র সঙ্গে। আইআইজি’র পরিবর্তে আইটিসি হিসেবে ব্যবসা করলে এক শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগি করবে ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল। এতে রাজস্ব হারাবে সরকার।’

আহমেদ জুনায়েদ আরও বলেন, ‘যদি আইটিসি ব্যান্ডউইথ কেনে— তাহলে তো তাদের ভ্যাট দিতে হচ্ছে না। অর্থাৎ এখানে আপনি ১০ শতাংশ ছাড় পাচ্ছেন। এআইটিও (অগ্রিম আয়কর) দিতে হচ্ছে না, আবার ভ্যাটও দিতে হচ্ছে না।  অর্থাৎ ১৫ শতাংশ এখানেই সরাসরি কস্ট সেভিং হচ্ছে।’

আইটিসি হিসেবে ব্যান্ডউইথ নিতে সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে ফাইবার অ্যাট হোম যুক্ত হলে সংযোগ পাবে ভারতের ওভারসিজ অপারেটররাও। এতে ভারত বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতের অপারেটররা ফাইবার অ্যাট হোমের মাধ্যমে এ দেশকে সরাসরি ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।