বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির পর সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) সংস্থাটি আয়োজিত ‘কোয়ার্টারলি রিভিউ অফ বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
এর আগে, ২৩ এপ্রিল নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনের কাজের মূল্যায়ন নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে সিপিডি।
প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হওয়ার যে আভাস সরকার দিচ্ছে, তা নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্দেহ পোষণ করেছে সানেম। সরকারের কথার সঙ্গে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোর তথ্য-উপাত্ত মেলে না দাবি করে তারা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্তগুলো পুনঃপর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে রফতানি, রেমিটেন্স ও বিদেশি বিনিয়োগ। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন রফতানি, রেমিটেন্স ও বিদেশি বিনিয়োগের চেয়েও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি কম আয়ের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি দিয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে না।’
চীনের প্রবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে, তারা বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করেছে। এজন্য তার গ্রোথ কমে যাচ্ছে, তাকে গ্রোথ স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের একটা ব্যখ্যা দিতে চাইলে সেই ব্যাখ্যাটি কিন্তু বিপজ্জনক। কারণ, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক কম। এত কম মাথাপিছু আয়ের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিয়ে এধরনের প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।’
অ্যাকাডেমিক ও পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে এই প্রবৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক।
সানেম এর পাঁচ উদ্বেগ:
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য কেন পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাঁচটি উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন সানেম এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
প্রথম উদ্বেগটি হচ্ছে, রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমার পরেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার উচ্চ প্রবৃদ্ধি। তার মতে, পরিসংখ্যান ব্যুরো বেসরকারি খাতে ব্যয়ের যে হিসাবে দেখিয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। সরকারি ব্যয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করা গেলেও ‘প্রাইভেট কনজামশন একটি পাজল’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দ্বিতীয় উদ্বেগ হলো, চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে শিল্প উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি। শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই অর্থবছরে কম রফতানি প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ কম হওয়ার পরও কীভাবে এত প্রবৃদ্ধি, তাও মেলাতে পারছে না সানেম।
তৃতীয় উদ্বেগটি হচ্ছে, দুর্বল বাণিজ্যিক পরিবেশের মধ্যেও উচ্চ শিল্প উৎপাদনে এত বেশি প্রবৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব হলো? সেলিম রায়হান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘২০১৮ সালে ব্যবসা-সহজীকরণ সূচকে আমরা পিছিয়েছি। ১৭৪ থেকে ১৭৬ নম্বর হয়ে ২ ধাপ পিছিয়েছি। একইভাবে লজিস্টিকস পারফরমেন্স সূচকেও বাংলাদেশ ৮৭ থেকে ১০০তম হয়ে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে গেছে।’
চতুর্থত, কম বিনিয়োগ দিয়ে শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার তথ্য একটা উদ্বেগের কারণ।
পঞ্চম উদ্বেগটি হলো, প্রবৃদ্ধির মান। বেশি প্রবৃদ্ধি দিয়েও দারিদ্র্য কমার প্রবণতা কম বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে প্রবৃদ্ধি আরও কম হলেও দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। কিন্তু এরপর থেকে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্যহার কমার প্রবণতা কমছে। যেমন ২০১৬ সালে দারিদ্র্য বিমোচন হার ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ।’
বাংলাদেশে জিডিপির বিপরীতে কর আদায়ের হার অন্য দেশগুলোর তুলনায় খুব কম বলেও উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সানেম চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার ও গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা।
