X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাচারের অর্থ কোথায় যায়, কী হয়?

গোলাম মওলা
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২৩:০২আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২৩:০৪

 দেশের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন উপায়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেন। আবার বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসাবে, বিদেশিরা বছরে পাচার হচ্ছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কেন বাংলাদেশ থেকে এত টাকা পাচার হয়। পাচারের অর্থ কোথায় যায়, পাচারের অর্থ দিয়ে কী হয়?
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদেশিরা যে পরিমাণ অর্থপাচার করছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থপাচার করছেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশে বিদেশিদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অধিকাংশ বিদেশি টাকা পাচার করলেও বাংলাদেশিরা পরিকল্পনা করে অর্থপাচার করছেন।’ তিনি  বলেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিকরা দুটি কারণে অর্থপাচার করছেন। প্রথমত, যারা আপ্রর্দশিত আয় বা কালো টাকা দেশে ভোগ করতে পারছে না। তারা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তুলছেন। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেও বাংলাদেশিরা টাকা পাচার করছে।  আর এই দুটো সেক্টরেই ব্যাপকভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকার পাহার হচ্ছে।’
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের সচেতন ও ধনী নাগরিকরা মনে করেন, বাংলাদেশ তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য নিরাপদ জায়গা নয়। এছাড়া সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা আছে যে, বাংলাদেশে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। এ কারণে ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পাঠানো, বিদেশে পড়ানো, বিদেশে চাকরি করতে দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশে টাকা পাচারও স্বাভাবিক বিষয় মনে করেন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা।’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থপাচার করে বিদেশে ছেলে-মেয়েদের স্থান করে দেওয়ার  প্রবণতা ৭০-এর দশক থেকেই চলে আসছে। তখন থেকে এখন, বড় বড় আমলা ও বড়  বড় রাজনৈতিক নেতারাই অর্থপাচারের এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।’

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)-এর কর্মকর্তারাও বলছেন, ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে কার কী আছে, এখন সবই জানা যায়। অনেক সময় নিজেরাই ফেসবুক বা বিভিন্ন মাধ্যমে বলে বেড়ায়। আর মানুষের যাতায়াত এখন সারা পৃথিবীতেই।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশে অর্থপাচার রোধে আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। দেশের বাইরে অর্থপাচারের অভিযোগগুলো নিয়ে বিএফআইইউ নিজেদের মতো করে কাজ করছে।’

জানা গেছে, অর্থপাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা যেসব দেশে বাড়ি করেছেন, সেসব দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম। মালয়েশিয়া সরকারের ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, রাজনীতিবিদসহ কয়েক হাজার নাগরিক নাম লিখিয়েছেন। সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে প্রকৃত বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ হাজারের মতো। তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন স্থানীয় কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতে। সেখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। ওই দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাঁচ তারা হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্টস কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অনেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বড় বড় শপিং মলে দোকানও কিনেছেন।

এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের অট্টালিকায় বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন।  

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব মতে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এর মধ্যে অধিকাংশই পর্যটন ভিসা নিয়ে দেশে এসে অনুমতি না নিয়েই অবৈধভাবে কাজ করছেন। তাদের হাত ধরে দেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে ২৬.৪ হাজার কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা পাচার হওয়ার পাশাপাশি বিদেশিরা অবৈধভাবে দেশে কাজ করায় রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে বলেও দাবি করেছে টিআইবি।  

তবে বিএফআইইউ এর তথ্য বলছে, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থপাচারকে উচ্চ ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে গত ১০ ডিসেম্বর দেশের সব ব্যাংকের প্রধার নির্বাহীর কাছে একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছে বিএফআইইউ।

বিএফআইইউ’র তথ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদও। তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থপাচার হচ্ছে। আর এই পাচারের অর্থ ঘুরেফিরে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে।’ তিনি মনে করেন, ‘পাচারের বড় অংশই বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ঘরবাড়িও হচ্ছে। কয়েকটি দেশের সেকেন্ড হোম প্রকল্পেও যাচ্ছে পাচারের অর্থ।’

খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে। টাস্কফোর্স কঠোরভারে নজরদারি করলে অর্থপাচার অনেকাংশে কমে আসবে। তবে অবৈধভাবে যেসব বিদেশি কাজ করছে, তাদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বের করে দিতে হবে। তাহলেই বিদেশিদের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব হবে।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)-এর গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। জিএফআই’র হিসাবে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ৫৯০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে। আর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছিল।

মূলত আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্য ও সেবার প্রকৃত মূল্য কী পরিমাণ গোপন করা হয়, তার হিসাবের ভিত্তিতে অর্থপাচারের প্রতিবেদন তৈরি করে জিএফআই।

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
বাংলাদেশকে ‘সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশকে ‘সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না